SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Question Answer As Per New Syllabus of SEBA Provided by The Roy Library is one of the best content available on the internet as well as many other offline books. SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Notes is made for SEBA Board Bengali Medium Students. SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Solutions We ensure that You can completely trust this content. SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Suggestions If you learn PDF from then you can BUY PDF SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী textbook Solutions. I hope You Can learn Better Knowledge.
SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী
Today’s We have Shared in This Post SEBA Class 10 Bengali (MIL) Chapter – 9 আদরণী Suggestions with you. SEBA Class 10 Bengali Solutions Chapter – 9 আদরণী I Hope, you Liked The information About The SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Notes. If you liked SEBA Class 10 Bengali Chapter – 9 আদরণী Question Answer Then Please Do Share this Post With your Friends as Well.
আদরণী
অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ
( ক ) অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। নগেন বাবুর পেশা কী?
উত্তরঃ নগেন বাবুর পেশা ছিল ডাক্তারী করা।
প্রশ্ন ২। জয়রামের পেশা কী?
উত্তরঃ জয়রাম পেশায় মোক্তার ছিলেন।
প্রশ্ন ৩। কুঞ্জবিহারীবাবু পেশায় ছিলেন ……………। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)
উত্তরঃ কুঞ্জবিহারীবাবু পেশায় ছিলেন জুনিয়ার উকিল।
প্রশ্ন ৪। মেজবাৰু কে?
উত্তরঃ মেজবাবু হলেন পীরগঞ্জের বাবু।
প্রশ্ন ৫। জয়রামের বয়স কত?
উত্তরঃ জয়রামের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে।
প্রশ্ন ৬। জয়রাম কার কাছে হাতি চেয়ে পাঠালেন?
উত্তরঃ মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে জয়রাম হাতি চেয়ে পাঠালেন।
প্রশ্ন ৭। জয়রামের আদি নিবাস কোথায় ছিল?
উত্তরঃ জয়রামের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলায়।
প্রশ্ন ৮। জয়রামের গাভীটির নাম কী ছিল?
উত্তরঃ জয়রামের গাভীটির নাম ছিল মঙ্গলা গাই।
প্রশ্ন ৯। কার নামে জয়রাম তাঁর গরুর বাছুরের নাম রেখেছিলেন?
উত্তরঃ ডেপুটিবাবুর নামে জয়রাম তাঁর গরুর বাছুরের নাম রেখেছিলেন।
প্রশ্ন ১০। উমাচরণ লাহিড়ীর বাসস্থান কোথায়?
উত্তরঃ উমাচরণ লাহিড়ীর বাসস্থান বারপুরে।
প্রশ্ন ১১। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা কোথায় হয়?
উত্তরঃ চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হয় বামুনহাটে।
প্রশ্ন ১২। আদরিণী কে?
উত্তরঃ বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে কিনে আনা হাতিটির নাম আদরিণী।
প্রশ্ন ১৩। ‘হাতি তোর ………….পায়ে………….’। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)।
উত্তরঃ ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’।
প্রশ্ন ১৪। ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’…………….এখানে ‘নাতি’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ এখানে “নাতি” শব্দের অর্থ লাথি।
প্রশ্ন ১৫। জয়রামের কয় ছেলে?
উত্তরঃ জয়রামের তিন ছেলে।
প্রশ্ন ১৬। আদরিণী গল্পে উল্লিখিত মেলা দুটির নাম লেখো।
উত্তরঃ মেলা দুটি হলো— চৈত্রসংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলা, রসুলগঞ্জের সপ্তাহব্যাপী মেলা।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও
প্রশ্ন ১। জয়রাম মুখোপাধ্যায় কে? তাঁর স্বভাবের পরিচয় দাও।
উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় হলেন একজন মোক্তার। তাঁর আদিনিবাস হল যশোর জেলায়। জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলামেশা করলেই বোঝা যায় যে, তাঁর হৃদয়টি স্নেহে, বন্ধুবাৎসল্যে কুসুমের মতো কোমল। তবে তাঁর মেজাজ ছিল কিছুটা রুক্ষ। যৌবনকালে তিনি রীতিমত বদরাগী ছিলেন। এখন রক্ত অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। সেই সময় হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার করলেই মুখার্জি মহাশয় রেগে অনর্থপাত করে তুলতেন।
প্রশ্ন ২। জয়রাম হাতি চেয়ে পাঠালেন কেন?
উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় পীরগঞ্জের মেজবাবুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু পীরগঞ্জে যাওয়ার রাস্তা খুব খারাপ ও ঘোড়ার গাড়ির পথ না থাকায় গোরুর গাড়ি করে যেতে হলে যেতে আসতে চারদিন লাগবে। পাল্কি করে যেতে চাইলেও তা যোগাড় করা মুশকিল। সেজন্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে জয়রাম রাজবাড়ীতে হাতি চেয়ে পাঠালেন।
প্রশ্ন ৩। জয়রামের প্রথমদিকের জীবনযাপন কেমন ছিল?
উত্তরঃ জয়রামের আদিনিবাস যশোর জেলায়। এখানে যখন প্রথম মোক্তারী করতে আসেন, তখন এদিকে রেল ছিল না। পদ্মা পার হয়ে কিছুটা নৌকাপথে, কিছুটা গোরুর গাড়িতে, কিছুটা পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটি। সহায় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। মাসিক তেরো সিকিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে নিজের হাতে রেঁধে খেয়ে মোক্তারী ব্যবসা শুরু করে দেন।
প্রশ্ন ৪। কার নামে এবং কেন জয়রাম তাঁর বাছুরের নাম রেখেছেন?
উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় যৌবনকালে ছিলেন কিছুটা বদরাগী। হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার করলেই মুখার্জি মহাশয় রেগে চেঁচিয়ে অনর্থপাত করতেন। একদিন এজলাসে এক ডেপুটির সঙ্গে জয়রামের বচসা বেঁধে যায়। বিকালে বাড়ি এসে দেখেন তাঁর মঙ্গলা গাই একটি এঁড়ে বাছুর প্রসব করেছে, তখন আদর করে সেই ডেপুটিবাবুর নামে বাছুরটির নামকরণ করেন।
প্রশ্ন ৫। কী কারণে আদালতে জয়রাম মোক্তারের জরিমানা হয়েছিল?
উত্তরঃ একবার এক ডেপুটির সামনে জয়রাম মুখোপাধ্যায় আইনের তর্ক করলেও হাকিম কিছুতেই তার কথায় সায় দিচ্ছিলেন না। অবশেষে রাগের মাথায় জয়রাম বলে বসেন— “আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন-জ্ঞান আছে হুজুরের তাও নাই দেখছি।” সেদিন আদালত অবমাননার কারণে মোক্তার মহাশয়ের পাঁচ টাকা জরিমানা হয়। তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়েছিলেন।
প্রশ্ন ৬। পত্রবাহক ভৃত্য হাতি সম্পর্কে কী খবর এনেছিল?
উত্তরঃ পত্রবাহক ভৃত্য এসে খবর দেয় যে হাতি পাওয়া গেল না। ভৃত্য জানায় সে চিঠি দেওয়ানকে দিয়েছিল। দেওয়ান চিঠি নিয়ে মহারাজের কাছে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে এসে খবর জানায় যে বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতির দরকার নেই। গোরুর গাড়িতে আসুক।
প্রশ্ন ৭। তাই ত! সব মাটি— কে কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন?
উত্তরঃ নগেন্দ্রবাবুর এই উক্তিটি করেছেন।
পীরগঞ্জে মেজবাবুর মেয়ের বিয়েতে যাবার জন্য জয়রামবাবু, মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে হাতি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রতি রবিবার দুপুরবেলায় পাড়ার যুবক-বৃদ্ধেরা জয়রাম মোক্তারের বৈঠকখানায় তাস পাশা খেলতেন। সেখানে মোক্তার মহাশয়ও থাকতেন। এমন সময় পত্রবাহক ভৃত্য এসে জানায়— মহারাজ হাতি দিতে রাজি হননি। সেইসময় নগেন্দ্রবাবু উক্তিটি করেছিল।
প্রশ্ন ৮। “পরের জিনিস, জোর তো নেই।”—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে তিনি এই উক্তি করেছেন?
উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের বৈঠকখানায় মিলিত হওয়া জনৈক ভদ্রলোকের উক্তি।
জয়রামবাবু বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে হাতি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। ভৃত্য এসে জানায় তাঁকে গোরুর গাড়িতে করে যেতে বলা হয়েছে। খবর শোনামাত্র জয়রাম ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠেন। তাঁর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরে পড়তে থাকে। মুখের শিরা উপশিরা ফুলে উঠতে থাকে। সেইসময় তাঁর বৈঠকখানায় সমবেত ভদ্রলোকদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি উক্তিটি করেছিলেন।
প্রশ্ন ৯। জয়রাম কোথা থেকে হাতি ক্রয় করলেন এবং কেন?
উত্তরঃ মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়রামের হাতি কেনার জন্য জেদ চেপে যায়। শহর থেকে দুই তিন ক্রোশের মধ্যে যে যে জমিদারের হাতি ছিল তাঁদের কাছে লোক পাঠান। রাত্রি দুই প্রহরের সময় খবর আসে যে—বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি বাচ্চা হাতি আছে। বিক্রি করবে— তবে প্রচুর দাম। জয়রামবাবু জেদবশত দুহাজার টাকা দিয়েই সেই হাতিটি ক্রয় করলেন।
প্রশ্ন ১০। জয়রামের বর্তমান নিবাস কোথায়?
উত্তরঃ জয়রামের বর্তমান নিবাস কলকাতায়।
প্রশ্ন ১১। “আপনি জ্ঞানী লোক, মায়া পরিত্যাগ করুন।”—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে?
উত্তরঃ উক্তিটি জয়রামবাবুর বন্ধুদের।
জয়রামবাবুর অবস্থা আগের মতো স্বচ্ছল ছিল না। বিষয় সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছিল, বড় নাতনি কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়েছিল, বিয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু আড়াই হাজার টাকা জোগাড় করা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিল, দুশ্চিন্তায় জয়রামের শরীর ভেঙে পড়েছিল। এর মধ্যে খবর আসে ছোট ছেলে বি. এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে। সেই সময় জয়রামবাবুর বন্ধুরা হাতিটিকে বিক্রি করে দেবার পরামর্শ দিয়েছিল।
প্রশ্ন ১২। আদরিণী কে? আদরিণীকে নিয়ে জয়রাম কীরূপ সমস্যায় পড়েছিলেন?
উত্তরঃ আদরিণী হল জয়রাম মোক্তারের পালিত মেয়ে হাতি।
জয়রাম আদরিণীকে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্রি করার পরামর্শ অনেকে দেন। কিন্তু কন্যাসমা আদরিণীকে বিক্রি করার ইচ্ছা জয়রামের ছিল না। বিক্রির কথায় তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে ম্লান মুখে বসে শুধুমাত্র চিন্তা করেন, মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।
প্রশ্ন ১৩। কল্যাণী কে? কত তারিখে বিয়ে ঠিক হয়েছিল?
উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের বড়ছেলের বড়মেয়ে হল কল্যাণী। ১০ই জ্যৈষ্ঠ কল্যাণীর বিয়ের দিন স্থির হয়েছে।
S.L. No. | সূচীপত্র |
অধ্যায় -১ | প্রার্থনা |
অধ্যায় -২ | বিজয়া দশমী |
অধ্যায় -৩ | গ্রাম্যছবি |
অধ্যায় -৪ | প্রতিনিধি |
অধ্যায় -৫ | আবার আসিব ফিরে |
অধ্যায় -৬ | সাগর-সঙ্গমে নবকুমার |
অধ্যায় -৭ | বাংলার নবযুগ |
অধ্যায় -৮ | বলাই |
অধ্যায় -৯ | আদরণী |
অধ্যায় -১০ | তোতাকাহিনি |
অধ্যায় -১১ | অরুণিমা সিনহা: আত্মবিশ্বাস ও সাহসের এক নাম |
অধ্যায় -১২ | কম্পিউটার কথা, ইন্টারনেট কথকতা |
অধ্যায় -১৩ | এসো উদ্যোক্তা হই |
অধ্যায় -১৪ | জীবন সংগীত |
অধ্যায় -১৫ | কাণ্ডারী হুঁশিয়ার |
অধ্যায় –১৬ | পিতা ও পুত্ৰ |
অধ্যায় -১৭ | অরণ্য প্রেমিক: লবটুলিয়ার কাহিনি |
অধ্যায় –১৮ | শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ |
অধ্যায় -১৯ | উজান গাঙ বাইয়া |
বাংলা ব্যাকরণ | |
S.L. No | বৈচিত্রপূর্ণ আসাম |
অধ্যায় -১ | তিওয়াগণ |
অধ্যায় -২ | দেউরিগণ |
অধ্যায় –৩ | নেপালিভাষী গোর্খাগণ |
অধ্যায় –৪ | বোড়োগণ |
অধ্যায় –৫ | মটকগণ |
অধ্যায় –৬ | মরাণগণ |
অধ্যায় –৭ | মিসিংগণ |
অধ্যায় –৮ | মণিপুরিগণ |
অধ্যায় –৯ | রাভাগণ |
অধ্যায় –১০ | চুটিয়াগণ |
দীর্ঘ উত্তর দাও
প্রশ্ন ১। জয়রামের চরিত্র বর্ণনা করো।
উত্তরঃ ‘আদরিণী’ গল্পে মোক্তার জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রের যে চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তা থেকে তাঁর চরিত্রের বৈচিত্র্যময়তার দিকটি প্রস্ফুটিত হয়। তাঁর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে একদিকে পৌরুষ, অপরদিকে স্নেহময়তা, বাৎসল্যরসের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের একটি উচ্চাঙ্গ চরিত্র নির্মাণ করে লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে প্রতিভার নিদর্শন রেখেছেন, সেকথা বলা বাতুলতা মাত্র। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ বিষয়ে সহমত।
‘আদরিণী’ গল্পে আদরিণীর নামে গল্পের নামকরণ হলেও এই গল্পের প্রধান চরিত্রটি হলেন জয়রাম মুখোপাধ্যায়। কেননা তাঁর জেদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোবাসা, অভিমান ইত্যাদি দ্বারাই সমগ্র গল্পটি পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। সেজন্য এই গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে চরিত্র নির্ভরতা। ছোটোগল্প সাধারণত যে দুটি রীতি অনুযায়ী লেখা হয়ে থাকে, তার মধ্যে এই গল্পটি চরিত্র-প্রধান রীতি অনুযায়ীই লেখা হয়েছে। কেননা জয়রামবাবুর হৃদয়লোকের নানা ধরনের ঘাতপ্রতিঘাতই গল্পের ওঠা-পড়া পরিণতি— সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। তাই, রীতি অনুযায়ী বিচার করলে গল্পটিকে চরিত্র-প্রধান গল্পই বলা যেতে পারে।
‘আদরিণী’ গল্পটি লিখিত হয়েছে মোট সাতটি পরিচ্ছেদে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের ঘটনাই জয়রামবাবুর চরিত্রের নানা বর্ণময় দিক ফুটিয়ে তুলেছে। পরিচ্ছেদগুলির ঘটনা ও তার পারম্পর্য জয়রামবাবুর চরিত্রের হৃদয়বৃত্তির নানা পরিচয় পাঠককুলের কাছে তুলে ধরেছে। শুরুতেই লেখক জয়রামবাবুর শরীরের একটি নিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে জীবনের শুরুতে যে কষ্ট তিনি করেছিলেন, তার বর্ণনাও দিয়েছেন— “পদ্মা পার হয়ে গরুর গাড়িতে পায়ে হেঁটে তিনি এসেছিলেন। সেদিন খুব সামান্যই সম্পত্তি ছিল—একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ এবং একটি পিতলের ঘটি।” আমরা শুরুতেই জানতে পেরেছি যে জয়রামবাবু বাইরে কঠোর ও কঠিন প্রকৃতির একজন মানুষ। তাঁর এই কঠোরতা ও কাঠিন্যের কারণ বোঝাতেই লেখক এই বর্ণনার অবতারণা করেছেন। তিনি যে পরিমাণ কষ্ট, সহিষ্ণুতা, পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে জীবনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাতে পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে লড়তে লড়তে চরিত্রগত ভাবে যে-কোনো মানুষের পক্ষেই কঠোর ও কঠিন হওয়াটা স্বাভাবিক। যে লোকটি সামান্য একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে পাথেয় করে জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল, বাড়ি, পুকুর, কোম্পানির কাগজ এবং মোক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সেই জীবনসংগ্রামে সফল হয়েছিলেন। বিনিময়ে তাঁর বাইরের কোমলতাটুকু হারিয়ে গিয়েছিল। কাঠিন্যই তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রবল আত্মসম্মান বোধ এবং সেই আত্মসম্মানকে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে রক্ষার পণ ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর জীবনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল যে আত্মসম্মানকে তিনি বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন, দুনিয়ার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে গিয়েও তাকে রক্ষা করা। অকুতোভয় ও বদরাগ ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম। কাউকে ভয় না পাওয়ার জন্য এবং নিজের বদরাগ ও জেদ বজায় রাখতে তিনি নিজের লোকসান করতেও পেছপা হতেন না। যেমন— কোনো একজন ডেপুটিবাবুর সাথে আদালতে বচসা হওয়ার জন্যে তিনি নিজের এঁড়ে বাছুরটির নাম রেখেছিলেন ডেপুটিবাবুর নামে। এর জন্য শাস্তির কোনো ভয় তিনি পাননি। আরো একবার আদালতে হাকিম আইনের তর্কে তাঁর পক্ষে সায় না দেওয়ায় বলেছিলেন— “আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন-জ্ঞান আছে, হুজুরের তাও নেই দেখছি।” অর্থাৎ সত্য কথা বলতে তিনি পিছপা হতেন না— তাতে যদি তিনি আদালত অবমাননার দায়ে পড়েন, তাতেও তাঁর ছিল না কোনো আপশোষ। এই কাজের জন্য তিনি সত্য সত্যই আদালত অবমাননার দায়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর পাঁচ টাকা জরিমানা হয়েছিল। কিন্তু নিজের বিচারে যেহেতু তিনি সঠিক ছিলেন, সেজন্য এই জরিমানা রদ করতে তিনি হাইকোর্ট অবধি গিয়েছিলেন এবং মোট সতেরোশো টাকা খরচের বিনিময়ে এই জরিমানা রদ করেছিলেন।
‘পাটিগণিতে ঠাসা মগজ’ আছে এধরনের যে-কোনো লোকই বলবে— পাঁচ টাকা জরিমানা রদ করতে গিয়ে সতেরোশো টাকা খরচ করা নিতান্তই মূর্খামির কাজ। কিন্তু আত্মসম্মান রক্ষার যে কোনো দাম হয় না— একথা জয়রামবাবুর মতো ব্যক্তিরাই একমাত্র মানতে পারবেন। সেজন্য সতেরোশো টাকার বিনিময়ে তিনি যে নিজের জেদ, অভিমান, অহংকার ও আত্মসম্মান রক্ষা করেছিলেন, সেকথা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু এই ধরনের ঘটনা তাঁর চরিত্রের একদিকের চিত্রের ওপরই আলোকপাত করেছিল বলা গেলেও জেদ, বদরাগই তাঁর চরিত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্য ছিল না। কোমল হৃদয়বৃত্তি, পরোপকার মনোভাবও তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। যেমন তিনি দু’হাতে অর্থ-উপার্জন করেছেন, তেমনি অকাতরে দরিদ্র, আর্ত মানুষের সাহাযার্থে তা ব্যয় করেছেন। তিনি অকাতরে অন্নদান করতেন। বিনা পয়সায় বহু উৎপীড়িত মানুষের মোকদ্দমা তিনি চালিয়েছেন। এমনকি প্রয়োজনে নিজের উপার্জন করা টাকা খরচ করেও বহু অসহায় লোকের মামলা চালিয়েছিলেন। এর থেকেই তাঁর চরিত্রের পরোপকারী দিকটি পাঠকদের সামনে ফুটে ওঠে। কোমল ও কঠিনের এই সংমিশ্রণ বড়ো একটি চোখে পড়ে না। কারণ যে অর্থ উপার্জন করার জন্য, যে প্রতিষ্ঠা পেতে তিনি জীবনে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করেছিলেন— যে কারণে তাঁর চরিত্রে এই কাঠিন্য, সেই উপার্জিত অর্থকে পরোপকারের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে তিনি কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। তাঁর কষ্ট, তাঁর কাঠিন্য তাঁকে ক্ষুদ্রমনস্ক করে তুলতে পারেনি। বরং তাঁর চরিত্রকে মহান করে তুলেছে ; একটি অনন্যমাত্রা দান করেছে। সাধারণের মধ্যে থেকেও তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছে।
তবে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান বোধের প্রখরতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায় পীরগঞ্জের জমিদার বাড়িতে নিয়ন্ত্রণে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। জয়রামবাবু ছিলেন পীরগঞ্জের জমিদারদের চারপুরুষের মোক্তার। সেই সূত্রে এই জমিদার পরিবারের সঙ্গে তাঁর বহুদিনের হৃদ্যতা। তাই যখন ওই জমিদার পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়ির মেজছেলের বিবাহে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এল, তখন বন্ধুদের অনুরোধে অবলীলায় তিনি জমিদারবাবুকে একটি হাতি পাঠানোর আর্জি জানিয়ে পত্র পাঠান। এর আগেও নিঃসঙ্কোচে তিনি এই ধরনের আর্জি জানিয়ে হাতি পেয়েছিলেন। সেজন্য এবারও তাঁর চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু এবার ঘটে অঘটন। বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়—যা তিনি কখনও আশা করেননি। পত্রের উত্তরে জমিদারবাবু হাতি না পাঠিয়ে খালি হাতেই পত্রবাহককে ফেরৎ পাঠান। এর উপর বলে বসলেন, নিমন্ত্রণ বাড়িতে আসতে হাতির প্রয়োজন নেই। তিনি পত্রবাহককে আরো বলেন যে, জয়রামবাবু যেন গোরুর গাড়িতেই আসেন। এই ঘটনাটি জয়রামবাবুর আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে যদি তিনি নিমন্ত্রণ বাড়িতেই যান, তবে হাতিতে চড়েই যাবেন, নতুবা যাবেন না। ফলে নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে হাতি কেনায় উঠে পড়ে লাগেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে দুহাজার টাকার বিনিময়ে তিনি একটি মাদি হাতি কেনেন এবং সেই হাতির পিঠে চড়েই তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। জমিদারবাবু হাতির মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করলে শ্লেষাত্মক উত্তর দিয়ে বলেন যে, যেহেতু তিনি রায়বাহাদুরের দ্বারা পালিত, সেহেতু হাতিটি জয়রামবাবু কিনলেও তার মালিকানা স্বত্ব আসলে জমিদারের। এইরূপে নিজের আত্মসম্মান ও আত্ম-অহংকার রক্ষা করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এই ঘটনাটি তাঁর আপোষহীন— ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি জয়রামবাবুর চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলেও তার অপর বৈশিষ্ট্যগুলির ভিতর আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর অপত্যস্নেহ, বাৎসল্যরস, বেদনাময়তা এবং মমত্ববোধের। জয়রামবাবুর চরিত্রে দুটি বৈশিষ্ট্যের সমান্তরাল প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। বন্ধু-বাৎসল্যের যে কাহিনি দিয়ে গল্পের সূত্রপাত, তার সমাপ্তি কন্যা-বাৎসল্যে। গরীব সাধারণ মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ তিনি অনুভব করতেন, তা ছড়িয়ে পড়েছিল মূক প্রাণীটির প্রতিও। মনুষ্যেতর প্রাণী হলেও তিনি হাতিটিকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে তার নাম রেখেছিলেন আদরিণী।
কিন্তু জীবনের দায় বড়ো দায়। মানুষের জীবনে যখন দুঃসময় আসে, তখন ভালোবাসাকেই আগে বলি দিতে হয়। জয়রামবাবুর জীবনের ক্ষেত্রে এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটেনি। পারিবারিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক চাপ ও অর্থনৈতিক সঙ্কট বৃদ্ধকে শেষ পর্যন্ত আদরিণীকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আগে অবশ্য তিনি আদরিণীকে ভাড়া দিয়ে সংসার ও আদরিণী দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানে ভাগ্য বিপরীত, সেখানে অসহায় মানুষ কী করবে? অগত্যা ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় তাঁকে। গল্পের শুরুতে জয়রামবাবুর যে দৃঢ় ও দাম্ভিক চরিত্রের পরিচয় মিলেছিল—সময়ের আঘাতে তা পরিণত হয়েছিল অসহায়তায়। এই মূক প্রাণীকে তিনি অপত্যস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন। বন্ধুরা বিক্রির কথা বলতেই তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন— “তার চেয়ে বল না তোমার এই ছেলে-পিলে নাতিপুতিদের খাওয়াতে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে—ওদের একে একে বিক্রি করে ফেল।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, বাইরের কঠিন আবরণের ভিতরেই ছিল নরম, স্নেহপ্রবণ একটি মন— যা মনুষ্যেতর প্রাণীকেও সন্তানস্নেহে আপন করে নেয়। অথচ বুকের পাঁজর ভেঙে পরিবার ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেই ভালোবাসার আদরিণীকেই বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ যে কত কঠিন কাজ তা তাঁর পরবর্তী আচরণগুলি থেকেই উপলব্ধি করা যায়। কঠিন পরিবেশ, সামাজিক চাপ কোনো কিছুতেই দমে না যাওয়া, হেরে না-যাওয়া জয়রামবাবু শেষপর্যন্ত সময়ের কাছে নতিস্বীকার করেন।
আদরিণীর নীরব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সেজন্য ঘটনায় যদিও লক্ষ্য করা যায়, আদরিণীকে রসগোল্লা খাইয়ে, বামুনহাটের মেলা দেখে আসতে বলে এই মূক প্রাণীটির সাথে ছলনা করছেন তিনি—প্রকৃতপক্ষে সে ছলনা তিনি করেছেন নিজেকে। তিনি হৃৎপিণ্ডের শিরা ছেঁড়া কষ্টকে চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। বামুনহাটের মেলায় আদরিণী বিক্রি না হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে যেন তিনি বেঁচেছেন। এখানে কোথায় গেল তাঁর ব্যক্তিত্ব! কোথায় গেল তাঁর বদরাগ, জেদ! এখানে শুধু দেখা যায় অপত্যস্নেহ, সন্তান-প্রতি ভালোবাসা এবং তার থেকে বিচ্ছেদের বেদনা ; যা পাঠক হৃদয়কে বেদনাতুর করে তোলে।
একজন সৎ, ব্যক্তিত্ববান পুরুষের পক্ষে এই ধরনের ছলনা করা বেশিদিন সম্ভব নয়। সেজন্য দ্বিতীয়বার যখন রসুলগঞ্জের মেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদরিণীকে, তখন তিনি থেকেছেন সম্পূর্ণ নিশ্চপ। আদরিণীকে ‘আর ছলনা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। আদরিণী যাওয়ার সময় চোখের জল ফেলেছে জানতে পেরে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা তিনি বুঝেছিলেন আদরিণী তাঁর ছলনা ধরতে পেরেছে। নীরবে, চোখের জলের মধ্য দিয়ে তার অভিমান জানিয়ে প্রাণীটি যে চলে গেছে তা তিনি বুঝেছিলেন। সেজন্য তার মন হাহাকার করে উঠেছিল। তারপর যখন শুনেছিলেন, আদরিণী অসুস্থ— তখনই বুঝতে পেরেছিলেন আদরিণী বিক্রির কথা বুঝতে পেরেছিল। প্রকৃতপক্ষে যখন ভাষা কাজ করে না, তখন মন কথা বলে। সেই অন্তরঙ্গ কথা আদানপ্রদানের জন্যেই জয়রামবাবু আর আদরিণী পরস্পর পরস্পরের মনের কথা বুঝতে পারত। এবারেও পেরেছিল। সেজন্য বাবার কাজের কোনো প্রতিবাদ না করে সে চলে যায়। আর সেই অভিমানের ধাক্কা এসে লাগে জয়রামবাবুর বুকে। আপাতকঠিন আবরণের ভিতরে থাকা নরম মন সে ধাক্কা সামলাতে পারেনি। প্রিয়জনকে হারাবার বেদনায় তাঁর জীবনীশক্তি কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছিল। এবং আদরিণীর অভিমানের বোঝা বুকে নিয়ে তিনি আর মাত্র দু’মাস জীবিত ছিলেন।
কাহিনির এই অংশ থেকে আমরা জয়রামবাবুর স্নেহবৎসল পিতার রূপটি খুঁজে পাই— যা তাঁর চরিত্রে একটি অন্যন্যমাত্রা দান করেছে। তাঁর বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব, বদরাগী মেজাজ, জেদ ইত্যাদিই যদি একতরফা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হত, তবে একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসাবেই তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকতেন। কিন্তু শুষ্ক খড়ের ওপরে মৃত্তিকার প্রলেপ লাগিয়ে, সুনিপুণ হাতে যেমন মূর্তি তৈরি করা হয়— তেমনই লেখক তাঁর সুনিপুণ হাতে মৃত্তিকার মতো তাঁর শুষ্ক শরীরে নরম, স্নেহপ্রবণ, বাৎসল্যরস পরিপূর্ণ পরোপকারী মনটি স্থাপন করে চরিত্রটিকে মহৎ করে তুলেছেন। আর এখানেই জয়রামবাবুর চরিত্রটি অনন্যতা লাভ করেছে।
প্রশ্ন ২। জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের জীবন সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তরঃ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা ‘আদরিণী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আদরিণীর পালনকর্তা জয়রাম মুখোপাধ্যায়। তাঁকে আমরা সহজেই আদরিণীর ‘পালক পিতা’ও আখ্যা দিতে পারি।
মামলার এক সহায়সম্বলহীন যুবক যশোহর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নৌকাযোগে পদ্মা পার হয়ে জেলা শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। তার সম্বল ছিল একটি পিতলের ঘটি আর একটি ক্যাম্বিশের ব্যাগ। ওই যুবকের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। ওই যুবক জেলা আদালতে মোক্তারি শুরু করে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। মহারাজের সঙ্গেও তার খাতির। এর কারণ মহারাজ তাঁরও মক্কেল। এ সমস্তই জয়রামের জীবনব্যাপী ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের ফসল।
এই পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি দীর্ঘদেহী, ঈষৎ চাপা গৌরবর্ণ, তার কাঁচা-পাকা মেশানো মোটা গোঁফ, মাথার সামনে বিস্তৃত টাক, ভাসা ভাসা চোখ এবং অম্লমধুর অন্তর নিয়ে সর্বজনপ্রিয় এবং অজাতশত্রু। তিনি কারণ ছাড়া কাউকে আঘাত করেন না, নিজেও আঘাত পেতে চান না। কোনো নীচ বা ছোটো কাজে তিনি নিজেকে কোনোদিন জড়াননি। আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। জয়রাম যেমন কুসুমের মতো কোমল তেমনি বজ্রের মতো কঠিন।
এই মানুষটি জীবনযুদ্ধে কৃতী হলেও পারিবারিক বা সাংসারিক জীবনে ভাগ্যতাড়িত। তিনি বিপত্নীক, প্রথম দুটি পুত্র মূর্খ ও নিষ্কর্মা, তাসুড়ে এবং নেশাখোর। বড়ো পুত্রটি ‘ফুলুট’ বাজায়। সব কাজেই অপটু, বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া। কনিষ্ঠ পুত্রটি বিএ পড়লেও পড়াশোনায় তেমনি মেধাবী নয়। এখানেই জয়রামের পরাজয়। তিনি বেশি নজর দিয়েছেন অর্থোপার্জনের দিকে, তার ফলে সংসারের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর দেবার সময় পাননি, আর সেজন্য তাঁর পুত্রেরা সব অযোগ্য। জয়রামের দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা এখানেই। এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে বলে জয়রাম কিছুটা সংবেদনশীল।
এই অভিমানী সংবেদনশীলতা জয়রামের চরিত্রটিকে চিনিয়ে দেয় গল্পের শুরুতেই। পাড়ার নগেন ডাক্তার ও জুনিয়র উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু জয়রামের বৈঠকখানায় এসেছিলেন পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কীভাবে যাওয়া যায় তার পরামর্শ করতে। কিন্তু জয়রাম নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কি না এই প্রশ্নে তিনি ক্ষুব্ধ ও অভিমানী হয়ে ওঠেন। তার কারণ আজ বিশ বছর ধরে পীরগঞ্জের বাবুরা তাঁর মক্কেল। জয়রাম তাঁদের আইনি উপদেষ্টা, আর তিনি নিমন্ত্রণ পাবেন না এটা তাঁরা ভাবল কী করে? তাই তিনি বলেই ফেলেন—“আমাকে বাদ দিয়ে তারা তোমাদেব নিমন্ত্রণ করবে, এইটে কী সম্ভব মনে কর?” এই কথা শুনে তারা ভুল স্বীকার করলে জয়রামের রাগ শান্ত হয়ে গেল।
জয়রাম মোক্তার আইনব্যবসাকে গুলে খেয়েছেন বলে তিনি অসৎ হননি। সেজন্য হাকিমেরা তাদের পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে অন্যায় অবিচার করলেই তিনি চেঁচিয়ে অনর্থ ঘটাতেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতেও দ্বিধা করতেন না। তিনি একবার এইরকম বচসায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর বাড়ির মঙ্গলা গাইয়ের এঁড়ে বাছুরের নামে নাম রেখেছিলেন হাকিমের। আর একবার অন্য এক হাকিমের স্বল্প আইনজ্ঞান দেখে তাঁকে কটাক্ষ করেন। ফলে তাঁর জরিমানা হয় পাঁচটাকা। কিন্তু অভিমানী জয়রাম এই পাঁচটাকা জরিমানার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত লড়েন। হাকিমের হুকুম রদ করে ছাড়েন। এর থেকেই অনুমান করা যায় তিনি কেবলমাত্র ন্যায়পরায়ণই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কেবলমাত্র অসম্ভব জেদীও। অত্যাচারিত উৎপীড়িত গরীব মানুষদের মোকদ্দমা তিনি অনেক সময়েই ফিস না নিয়ে নিজের অর্থব্যয়ে চালিয়েছেন, এমনকি তিনি অকাতরে অন্নদানও করতেন।
জয়রামের ক্ষোভ, অভিমান ও অপমানের জবাব হিসাবে মুখোপাধ্যায় পরিবারে আদরিণীর আবির্ভাব। তাঁকে মহারাজা নরেশচন্দ্র হাতি দিতে চাননি তার বদল হিসেবেই তিনি নেহাতই ঝোঁকের বশে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন এবং অম্লমধুর প্রতিশোধও নিয়েছিলেন এই ঘটনার। তিনি হাতিতে চেপে মহারাজ নরেশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পীরগঞ্জ থেকে ফেরার পরের দিনই। হাতি দেখে মহারাজ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন কার হাতি। উত্তরে জয়রাম জানিয়েছেন— “আজ্ঞে হুজুর বাহাদুরেরই হাতি।” মহারাজ আবার বিস্ময়সূচক প্রশ্ন করাতে উত্তরে জয়রাম বলেছেন— “যখন হুজুর বাহাদুরের দ্বারাই প্রতিপালিত হচ্ছি— আমি যখন আপনার তখন হাতি আপনার বৈ আর কার।” মহারাজ এ কথার প্রকৃত অর্থ কী তা বুঝেছেন। মিষ্টি কথায় কী করে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যায় তা খুব ভালোভাবে জানতেন জয়রাম মোক্তার।
জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীনপন্থী, মূল্যবোধসম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষ। তাঁর নিজের পুত্রেরা উপযুক্ত নয় এবং তাঁর ছিল না কোনো কন্যাসন্তান। সেজন্য প্রৌঢ় জয়রামের হৃদয়ে কন্যার জায়গাটি দখল করে নেয় আদরিণী। জয়রাম সত্যবাদী। তিনি জজের কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন যে তিনি ইংরাজী জানেন না। তিনি দায়রা খুনের মামলায় জিতে জজসাহেবের কাছ থেকে প্রশংসা পাবার পরই কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেন। তাঁর মনে হয়েছিল কর্মক্ষেত্র থেকে মাথা উঁচু করে সরে যাওয়াই উচিৎ। কেননা তিনি মনে মনে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজী জানা মোক্তারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তিনি পারবেন না। সেক্ষেত্রে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে সরে যাওয়াই ভাল। তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন। সেজন্য জজসাহেবের মুখে প্রশংসা শুনে সার্থকতার আনন্দে বিহ্বল হয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে যায়।
কিন্তু জয়রামের অবসর জীবন সুখের হয়নি। আয় নেই, সংসার চালানোর জন্য জমানো অর্থও ক্রমশ কমছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আদরিণীর খোরাক মেটাবার জন্য যে খরচ তা তাঁর বন্ধুদের কাছে বাহুল্য মনে হলেও জয়রামের তা মনে হয়নি। তিনি আদরিণীকে ছেলেপুলে নাতিনাতনিদের সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি হাতি ভাড়ার বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। কিন্তু এইসমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর দ্বিধা ফুটে উঠেছে প্রতি পদে। তাঁর আড়াই হাজার টাকা অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বড়ো নাতনি কল্যাণীর বিবাহের জন্য। তখন বাধ্য হয়ে জয়রাম আদরিণীকে বিক্রির জন্য পাঠিয়েছিলেন মেলায়। কিন্তু মেলায় পাঠিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে— আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে এই ভয়ে লোকজনদের বলেছেন— “একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর তাতে দাম যদি দুপাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার।” এই ঘটনায় এক স্নেহার্দ্র পিতার অন্তরের প্রকাশ পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় যেভাবে পিতা কন্যাকে আশীর্বাদ করে, সেইভাবেই তিনি আদরিণীকেও বামুনহাটের মেলায় যাবার সময় মিষ্টিমুখ করিয়েছেন, গায়ে হাত বুলিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু কন্যাকে বিদায়দানের সময় স্নেহশীল পিতা যেভাবে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারেন না, জয়রামও পারেননি তাকে বিদায় জানাতে। আদরিণী চলে যাবার পর তাঁর শোকে বিহ্বল হয়ে ভেঙে পড়ার দৃশ্যটিও কন্যাকে বিদায়ের সময় পিতার শোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে।
দ্বিতীয়বার মেলায় নিয়ে যাবার পথে আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তিনি উদ্বেগে অস্থির হয়ে পড়েন। পায়চারি করতে থাকেন পাগলের মতো। আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাঁর মনে হয়েছে তাঁর প্রতি অভিমানেই আদরিণীর এই অসুস্থতা। পিতৃহৃদয়ের শোকবিজড়িত মূর্তি হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এই আক্ষেপ। সেজন্য আদরিণীর মৃত্যুতে তিনি যেভাবে ভেঙে পড়েছেন তা কোনো সন্তানের মৃত্যুতে শোকাহত পিতার ভেঙে পড়ারই শামিল। জয়রাম এই আঘাত সামলাতে পারেননি, তিনিও দুমাস পরেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
মুক পশুর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনে জয়রাম এক উজ্জ্বল চরিত্র। মূল্যবোধসম্পন্ন নিষ্ঠাবান সৎ, সংবেদনশীল চরিত্রসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যে এখন দুর্লভ।
প্রশ্ন ৩। “হাতি দিলে না। হাতি দিলে না!” —উক্তিটি কার? প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ উক্তিটি মোক্তার জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের।
জয়রাম মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের একজন নামকরা মোক্তার। আদালতে ছিল তাঁর যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি। জয়রামবাবুর বৈঠকখানায় একদিন বিকালে তাঁর দুই বন্ধু পাড়ার নগেন ডাক্তার এবং জুনিয়ার উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু পান খেতে খেতে হাতের ছড়ি দোলাতে দোলাতে এসে উপস্থিত হন। তাঁদের কাছ থেকেই জয়রামবাবু জানতে পারেন যে পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের নিমন্ত্রণ তাঁরা পেয়েছেন। নগেন ডাক্তার ও কুঞ্জবিহারী জয়রামবাবুকে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি রেগে যান। কেননা তিনি পীরগঞ্জের বাবুদের এষ্টেটের কুড়ি বছরের বাঁধা মোক্তার। নিমন্ত্রিতের তালিকা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া নিয়ে সমস্যা উপস্থিত হয়, পীরগঞ্জের যাওয়ার রাস্তাটি ছিল মেঠো, সেখানে ঘোড়ার গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই, গোরুর গাড়িতে যাওয়া যায়। কিন্তু তাতে যেতে দুদিন আসতে দুদিন লাগবে। সেজন্য খুব সহজে যাওয়ার জন্য বন্ধুরা জয়রামবাবুকে একটি হাতির বন্দোবস্ত করতে বলেন। জয়রাম খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বন্ধুদের চিন্তামুক্ত থাকতে বলেন। কেননা তিনি হলেন বর্তমান জমিদারের বাপের আমলের মোক্তার। সেজন্য তিনি হাতি চেয়ে রাজবাড়িতে চিঠি পাঠালেন। সন্ধ্যা নাগাদ হাতি এসে পৌঁছে যাবে। এখানেই সমস্যার উৎপত্তি হয়। পরের দিন রবিবারের সকালে পূজা আহ্নিক সেরে জয়রামবাবু বেলা নটার সময় জলযোগ করে বৈঠকখানায় এসে বসেন। মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাতির কথা মনে পড়ে যায়। তখন কাগজ কলম নিয়ে চশমা পরে “প্রবল প্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীমন্মহারাজ শ্রীনরেশচন্দ্র রায় চৌধুরী বাহাদুর আশ্রিতজনপ্রতিপালকেষু” পাঠ লিখে দুতিন দিনের জন্য একটি সুশীল ও সুবোধ হাতি প্রার্থনা করে চিঠি লেখেন। আগেও তিনি অনেকবার জমিদারের কাছ থেকে হাতি আনিয়েছেন বলে এবারও দৃঢ়বিশ্বাস ছিল চিঠি পাওয়া মাত্রই মহারাজ নরেশচন্দ্র হাতি পাঠিয়ে দেবেন। সেজন্য হাতিকে বাঁধবার জন্য বাগানে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করা হল হাতির খাওয়ার জন্য বড় বড় পাতাশুদ্ধ কয়েকটা কলাগাছ ও অন্যান্য গাছের ডাল কেটে আনা হল এবং মোক্তার মহাশয় নিজে সমস্ত কাজে তদারক করেন।
সন্ধ্যার কিছু আগে জয়রাম বৈঠকখানায় বসে পাশা খেলা দেখছেন। এমন সময় ভৃত্য দুঃসংবাদ নিয়ে আসে। ভৃত্য জানাল —মহারাজ নরেশচন্দ্র হাতি পাঠাবেন না, বরং বলেছেন— বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতি পাঠাবার প্রয়োজন নেই। জয়রামবাবুদের মহারাজ গোরুর গাড়িতে আসতে বলেছেন। ভৃত্যের আনা এই সংবাদ জয়রামবাবুর আত্মসম্মানে আঘাত করে। তিনি ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তাঁর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। দুই চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরতে লাগল। মুখের শিরা উপশিরাগুলি ফুলে উঠল, কম্পিত স্বরে ঘাড় বাঁকিয়ে বারবার বলতে লাকেন “হাতি দিলে না! হাতি দিলে না!”
প্রশ্ন ৪। —“এ বিবাহে আমার যাওয়াই হবে না।”—উক্তিটি কার? এখানে কার বিবাহের কথা বলা হয়েছে? বক্তা সেই বিবাহে যেতে চান না কেন?
উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের। এখানে পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের বিয়ে।
জয়রাম মুখোপাধ্যায় একজন নামকরা মোক্তার। তিনি মহারাজ নরেশচন্দ্রের বাপের আমলের মোক্তার। জয়রামবাবু বন্ধু নগেন এবং জুনিয়র উকিল কুঞ্জবিহারীকে সাথে নিয়ে পীরগঞ্জে যাওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যদিকে। পীরগঞ্জে যাওয়ার রাস্তা ভালো নয়। ঘোড়ার গাড়ির পথ নেই। গোরুর গাড়ি করে যেতে হলে যেতে আসতে চারদিন লাগে। পালকি যোগাড় করে যাওয়াও মুশকিল। সেজন্য জয়রাম মোক্তার ভাবেন রাজবাড়ি থেকে হাতি এনে তাঁর পিঠে চেপে বন্ধুসহ নিমন্ত্রর রক্ষা করতে যাবে। এরকম কাজ তিনি পূর্বেও করেছেন। তাই তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল।
কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না, জয়রামবাবুর ভৃত্য চিঠি নিয়ে রাজবাড়িতে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার আগে সে দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরে আসে। ভৃত্য জানায়—মহারাজ হাতি পাঠাতে রাজি নন। উপরন্তু বলেছেন বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতি পাঠাবার দরকার নেই। জয়রামবাবুরা গোরুর গাড়িতে আসুক। আত্মাভিমানী জয়রামবাবু মহারাজের এই আচরণে প্রচণ্ডভাবে আহত হলেন। তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা শরীর রাগে উত্তেজনায় জ্বলে উঠে। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বন্ধুরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে গোরুর গাড়িতে যাওয়াই শ্রেয় বলে মন্তব্য করেন।
কিন্তু জয়রামবাবু এই অপমান মেনে নিতে পারলেন না। মনস্থির করেন যদি বিয়েতে যেতেই হয় তবে হাতির পিঠে চেপেই যাবেন, নতুবা অপর কোনো যানবাহনে যাবেন না। আর যদি হাতির বন্দোবস্ত না হয় তবে তিনি বিয়ে বাড়িতে যাবেনই না। তাই হাতির সন্ধানে নানাদিকে লোক পাঠালেন। শেষ পর্যন্ত বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে দুহাজার টাকায় একটি মেয়ে হাতি কেনেন। মেয়ে হাতিটির নাম রাখেন আদরিণী। আদরিণীর পিঠে চেপেই বন্ধুসহ জয়রামবাবু পীরগঞ্জে বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান।
প্রশ্ন ৫। মেজবাবুর মেয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য জয়রাম কী উপায় করলেন এবং কেন?
উত্তরঃ পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ জয়রামবাবু, নগেন ডাক্তার এবং উকিল কুঞ্জবিহারী তিনজনেই পান। কিন্তু পীরগঞ্জের যাতায়াতের রাস্তাটি খুব খারাপ, ঘোড়ার গাড়ি বা গোরুর গাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়, পালকিও পাওয়া যাবে না। সেজন্য নগেনবাবু পরামর্শ দেন রাজবাড়ি থেকে যদি হাতি আনিয়ে নেওয়া যায় তবে অনায়াসেই তিনজনে হাতির পিঠে চড়ে বিয়েবাড়ি যাওয়া যায়। নগেনবাবুর পরামর্শ জয়রামবাবুর মনঃপূত হয়। তিনি রাজবাড়ি থেকে হাতি পাঠাবার জন্য ভৃত্যের হাতে চিঠি পাঠিয়ে দেন। জয়রামবাবু ভেবেছিলেন তাঁর চিঠি গেলেই রাজবাড়ি থেকে হাতি চলে আসবে।
কিন্তু জয়রামবাবুর আশা পূর্ণ হল না। মহারাজ নরেশচন্দ্র জানিয়ে দেন বিয়েবাড়িতে যেতে হাতি পাঠাবার দরকার নেই। বরং তাঁরা গোরুর গাড়িতে আসুন। মহারাজের এই আচরণে জয়রামবাবু প্রচণ্ড অপমানিত হন। তাঁর জেদ চেপে গেল যদি বিয়েবাড়িতে যেতে হয় তবে হাতির পিঠে চড়েই যাবেন, নাহলে যাবেন না। গোরুর গাড়িতে চড়ে জয়রামবাবু যাবেন না।
শহর থেকে দু’তিন ক্রোশের মধ্যে দু’তিন জমিদারের হাতি ছিল। সেই রাত্রেই প্রত্যেকের কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন, যদি কেউ হাতি বিক্রি করে তবে তিনি কিনে নেবেন। রাত্রি দুপ্রহরের সময় খবর আসে বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি মেয়ে হাতি আছে ; বিক্রি করতে চায়। বাচ্চা হলেও সওয়ারী নিতে পারবে কিন্তু দাম দুহাজার টাকা দিতে হবে। জয়রামবাবু তাতেই রাজি হয়ে যান। জয়রামবাবু খবর পাঠালেন পরের দিন সকালেই যেন লাহিড়ীবাবু বিশ্বাসী কর্মচারী দিয়ে হাতিটিকে পাঠিয়ে দেন এবং টাকা নিয়ে যান। পরের দিন বেলা সাতটার সময় মেয়ে হাতিটি আসে। তার নাম রাখেন আদরিণী। আদরিণীর পিঠে চড়েই বন্ধুসহ জয়রামবাবু পীরগঞ্জে বিয়েবাড়ি যান।
প্রশ্ন ৬। আদরিণী কে? তার আগমনে গ্রামের কী অবস্থা হয়েছিল বর্ণনা করো।
উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের পোষা মেয়ে হাতি হল আদরিণী। তিনি আদরিণীকে লাহিড়ী মহাশয়ের কাছ থেকে দুহাজার টাকায় কিনেছিলেন।
জয়রামবাবুর বাড়িতে আদরিণী আসামাত্রই পাড়ার সব বালকরা এসে বৈঠকখানার উঠোনে ভিড় করে দাঁড়াল। কয়েকজন দুষ্টু বালক সুর করে বলতে থাকে— ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’। বাড়ির বালকরা অত্যন্ত রেগে গেল এবং তাঁদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আদরিণী গিয়ে অন্তঃপুরের দরজার কাছে দাঁড়ায়। জয়রামবাবু বিপত্নিক ছিলেন। তাঁর বড়ো পুত্রবধূ একটি ঘটিতে জল নিয়ে ভীত পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসেন। কাঁপা হাতে হাতিটির চারটি পায়ে একটু একটু করে জল ঢেলে দেন। মাহুতের ইঙ্গিত অনুসারে আদরিণী জানু পেতে বসল। বড়ো পুত্রবধূ তেল ও সিঁদুরে তাঁর কপাল রাঙিয়ে দেন। ঘন ঘন শঙ্খ বাজতে থাকে। তারপর আদরিণী উঠে দাঁড়ালে একটা ধামায় ভরে আলো চাল, কলা ও অন্যান্য মঙ্গল দ্রব্য তাঁর সামনে রাখা হয়। আদরিণী শুড় দিয়ে তুলে কিছুটা খেল, কিছুটা চারদিকে ছড়াল, এরূপে বরণ শেষ হলে রাজহাতির জন্য আনা কলাগাছ এবং গাছের ডালপালা খেতে থাকল।
প্রশ্ন ৭। জয়রামের বাড়িতে আদরিণীকে কীরূপে আপ্যায়ন করা হয়েছিল?
উত্তরঃ জয়রামবাবুর বাড়িতে আদরিণী আসামাত্রই পাড়ার সব বালকরা এসে বৈঠকখানার উঠোনে ভিড় করে দাঁড়াল। কয়েকজন দুষ্টু বালক সুর করে বলতে থাকে— ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’। বাড়ির বালকরা অত্যন্ত রেগে গেল এবং তাঁদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আদরিণী গিয়ে অন্তঃপুরের দরজার কাছে দাঁড়ায়। জয়রামবাবু বিপত্নিক ছিলেন। তাঁর বড়ো পুত্রবধূ একটি ঘটিতে জল নিয়ে ভীত পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসেন। কাঁপা হাতে হাতিটির চারটি পায়ে একটু একটু করে জল ঢেলে দেন। মাহুতের ইঙ্গিত অনুসারে আদরিণী জানু পেতে বসল। বড়ো পুত্রবধূ তেল ও সিঁদুরে তাঁর কপাল রাঙিয়ে দেন। ঘন ঘন শঙ্খ বাজতে থাকে। তারপর আদরিণী উঠে দাঁড়ালে একটা ধামায় ভরে আলো চাল, কলা ও অন্যান্য মঙ্গল দ্রব্য তাঁর সামনে রাখা হয়। আদরিণী শুড় দিয়ে তুলে কিছুটা খেল, কিছুটা চারদিকে ছড়াল, এরূপে বরণ শেষ হলে রাজহাতির জন্য আনা কলাগাছ এবং গাছের ডালপালা খেতে থাকল।
প্রশ্ন ৮। “ ওদের একে একে বিক্রী করে ফেল।’—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ জয়রামবাবু মহারাজ নরেশচন্দ্রের কথায় অপমানিত হয়ে জেদ বশত উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে ২০০০ টাকায় আদরিণীকে কিনেছিলেন। এই ঘটনার পর সুদীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেছে। এই পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মের আইন ব্যবসায়ীর কদর নেই। ক্রমশ জয়রামবাবুর আয় কমতে থাকল। আগের মতো উপার্জন হয় না। অথচ প্রতিবছর ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাঁর তিনজন পুত্রের দুটিরই কোনো উপার্জন নেই। শুধু ছোটো ছেলেটি কলকাতায় পড়ছে।
কথাতেই বলা হয়— হাতির খরচ— আদরিণীর পেছনে খরচও হয়ে দাঁড়াল জয়রামবাবুর কাছে ‘বোঝার ওপর শাকের আটি’। এরপর ঘটনাক্রমে জয়রামবাবু কাছারি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ায় মুখোপাধ্যায়ের সংসার অত্যন্ত কায়ক্লেশে চলতে থাকল। ব্যয় যে পরিমাণ কমিয়ে ফেলবেন ভেবেছিলেন তা শত চেষ্টাতেও সম্ভব হল না। সুদে সঙ্কুলান হয় না— মূলধন খরচ হতে শুরু হয়। কোম্পানীর কাগজেও হাত পড়ে।
একদিন সকালে মোক্তার মহাশয় বৈঠকখানায় বসে নিজের অবস্থার বিষয় চিন্তা করছেন এমন সময় মাহুত আদরিণীকে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যায়। অনেকদিন থেকেই অনেকে পরামর্শ দিচ্ছিল— আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। তাঁতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে। কিন্তু মুখার্জি মহাশয় উত্তর দেন— তার চেয়ে ছেলে বৌ নাতি নাতনিদের খাওয়াতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে, ওদের একে একে বিক্রি করে ফেলা যায়।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি আয় বুঝে ব্যয় করেন। কেননা তাঁরা জানেন, ওজন বুঝে না চললে পরিণামে দুঃখ পেতে হবে। দিনেরবেলায় সূর্যের আলো সবাই দেখতে পায়, অপর কোনো আলোর তখন প্রয়োজন পড়ে না। রাত্রির অন্ধকারে আলোর প্রয়োজন কিন্তু নিজের অপদার্থ খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য কেউ যদি দিনেরবেলায় আলো জ্বালায় তবে তার বুদ্ধি বিবেচনার অভাব আছে, এ কথাই বুঝতে হবে। হয়তো এমন সময় আসবে, যখন আলোর বড়ই প্রয়োজন, তখন তাঁর আলো জ্বালাবার সামর্থ্যই থাকবে না।
মানুষকে সাংসারিক নানা প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করতে হয়, কিন্তু তা পরিমিত এবং যথোচিত হওয়া প্রয়োজন। নিজের ঐশ্বর্য গরিমা প্রদর্শনের জন্য যাঁরা অকারণ অর্থ বা শক্তি ব্যয় করেন তাঁরা অপরিণামদর্শী। মানুষের যতটুকু শক্তি সামর্থ্য, তার বাইরে গেলেই অনর্থ ঘটে। যাঁরা পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধনরত্নের অধিকারী তাঁরাও যদি ভোগবিলাসের মাত্রা ছাড়িয়ে যান তবে তাঁদের শেষ জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে অতিবাহিত করতে হবে। কৃপণের মতো কেবল অর্থসঞ্চয় যেমন বাঞ্ছিত নয়, তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনক্ষয়ও কাম্য নয়। অর্থের সদ্ব্যয় করলে তবেই জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী হওয়া যায়, নতুবা অমিতব্যয়িতার ফলস্বরূপ জীবনে কেবল দুঃখ্যাতনাই ভোগ করতে হয়।
প্রশ্ন ৯। ‘যেনো হারাধন ফিরিয়া পাওয়া গিয়াছে’—উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, অভিমান ও অপমান হিসেবে মুখোপাধ্যায় পরিবারে আদরিণী এসেছিল। তাঁকে হাতি দিতে মহারাজা নরেশচন্দ্র চাননি, সেজন্য তার বদল হিসেবেই তিনি নেহাতই ঝোঁকের বশে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন এবং অম্লমধুর প্রতিশোধও নিয়েছিলেন এই ঘটনায়। তিনি হাতিতে চেপে মহারাজ নরেশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পীরগঞ্জ থেকে ফেরার পরের দিনই।
জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীন ধ্যান-ধারণার মানুষ, তাঁর কোনো পুত্রই উপযুক্ত নয়। জয়রামবাবুর কোনো কন্যাসন্তান ছিল না, সেজন্য পঞ্চাশ পেরনো বৃদ্ধের হৃদয়ে কন্যার স্থান দখল করে নেয় আদরিণী। জয়রামের অবসর জীবন সুখের নয়। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ায় অস্বচ্ছলতা দেখা দেয়। ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছিল না। সুদে সংসার চলছে না বলে মূলধনও খরচ হতে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমতে লাগল। তখন অনেকে আদরিণীকে বিক্রি করে দেবার পরামর্শ দেয়। এতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বাঁচবে। কিন্তু আদরিণী ছিল জয়রামবাবুর আত্মার আত্মীয়, জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেজন্য তাঁকে বিক্রি করার কথা তিনি কখনো ভাবতে পারেন নি। সেজন্য ঠিক হল আদরিণীকে ভাড়া দেওয়া হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দূরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে আদরিণীকে ভাড়া দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনে দেওয়া হলেও সেভাবে সাড়া পাওয়া গেল না।
এরমধ্যে নতুন সমস্যা উপস্থিত হয়। জয়রামবাবুর বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর ডাক্তার ওষুধ খরচে ৫।৭ টাকা ব্যয় হতে লাগল। মাসখানেক পরে নাতি কিছুটা সুস্থ হলে বড়বৌ ও মেজবৌ একসাথে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে।
এদিকে বড় নাতনি কল্যাণীর বারো বছর বয়স হতে চলল, শীঘ্রই তাঁর বিয়ে দেওয়া দরকার। নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ এলেও পছন্দসই হচ্ছিল না। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের বাবার কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। সে সর্বক্ষণ নেশাভাঙ করে, তাসপাশা খেলে বেড়াত, যত দায় জয়রামবাবুর ওপরেই ছিল। অবশেষে কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। পাত্রটি রাজশাহী কলেজে এল-এ পড়ে। কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন করতে হলে আড়াই হাজার টাকার দরকার।
এমতাবস্থায় সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিতে থাকে। জয়রামবাবুকে আদরিণীর প্রতি মায়া ত্যাগ করতে বলেন। শুনে জয়রাম বারংবার কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে থাকেন। অবশেষে চৈত্র সংক্রান্তির ১৫ দিন আগে শুরু হওয়া বামুনহাটের মেলায় আদরিণীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে জয়রামবাবুর মেজোছেলে যাবে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যাবেলা আদরিণী মেলা থেকে ফিরে এল, বিক্রি হয়নি। নায্য মূল্য দেবার খরিদ্দার জোটেনি। আদরিণীকে ফিরে আসতে দেখে বাড়িতে আনন্দের কোলাহল পড়ে যায়। বিক্রি হয়নি বলে কারো মনে খেদের চিহ্ন ছিল না। বাড়ির সকলে এমন আচরণ শুরু করল যেন হারানো ধন ফিরে পাওয়া গেছে। মানুষ বিশ্ববিধাতার মহান সৃষ্টি, বিধাতা তাকে যে মহাসম্মান দান করেছেন তাকে রক্ষা করাই তার কর্তব্য।
এই পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের মূলে আছে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ। জগতের বিশাল ক্ষেত্রে যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে মানবজাতির কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, হৃদয়ধর্মের প্রেরণায় যারা দুঃখীজনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের জীবনই সার্থক, পরার্থপরতাই জীবনের চরিতার্থতার মূল। নিঃস্বার্থ এবং উদার মন নিয়ে যারা বেঁচে থাকেন তাঁদের জীবনই সফল। বস্তুত স্বার্থমগ্ন মানুষের সঙ্গে বিশ্বজনের হৃদয়ের কোনো যোগ নেই। পৃথিবীতে যে সকল মহাপুরুষ আবির্ভূত হয়েছেন তাঁরা সকলেই পরহিতব্রতে দীক্ষিত। যদি স্বার্থমগ্ন মানুষ স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে নিজেদের সত্তাকে মানবগোষ্ঠীর সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিত, তবে তাদের জীবন ব্যর্থ হত না।
প্রশ্ন ১০। “ওঁর মুখ দিয়ে ব্রহ্মাক্য বেরিয়েছে….” —রহ্মবাক্য বলতে কী বোঝায়? কার মুখ দিয়ে এই বাক্য নির্গত হয়েছে? এবং বাক্যটি কী?
উত্তরঃ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণদের মুখ থেকে যে বাক্য বের হয় সেই বাক্যই ফলপ্রসূ হয়, তাকেই বলে ব্রহ্মবাক্য।
জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে এই বাক্য বের হয়েছে। সংসারে আর্থিক অনটনের কারণে সকলে জয়রামবাবুকে পরামর্শ দিয়েছিল আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়া হোক। তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বাঁচবে। কিন্তু জয়রামবাবু গররাজি ছিলেন। আদরিণী জয়রামবাবুর কাছে ছিল কন্যাসমা। আদরিণীকে বিক্রি করার কথায় তার চোখে জল আসে। কিন্তু নাতনি কল্যাণীর বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার খুব দরকার হয়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলায় আদরিণীকে বিক্রির জন্য পাঠান। কিন্তু মেলায় পাঠিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে এই ভয়ে লোকজনদের বলেছেন— একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর তাতে দাম যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় পিতা যেভাবে কন্যাকে আশীর্বাদ করে সেভাবেই জয়রাম আদরিণীকে নিজে হাতে রসগোল্লা খাইয়ে দিয়েছেন। শেষে তাঁর গলার নীচে হাত বুলাতে বুলাতে ভগ্ন কণ্ঠে বলেছেন— “আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।” প্রাণ ধরে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন না। উদ্বেল দুঃখে এই ছলনার আশ্রয় নিলেন।
প্রশ্ন ১১। “আজ আর বৃদ্ধ তাহার কাছে গিয়া বিদায় সম্ভাষণ করিতে পারিলেন না।”—বৃদ্ধটি কে? তিনি কাকে বিদায় সম্ভাষণ করতে পারলেন না এবং কেন?
উত্তরঃ বৃদ্ধটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়। তিনি আদরিণীকে বিদায় সম্ভাষণ করতে পারলেন না।
মহারাজা নরেশচন্দ্রের কাছে অপমানিত হয়ে জয়রামবাবু দুহাজার টাকায় উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে আদরিণীকে কিনেছিলেন। আদরিণী যখন জয়রামবাবুর বাড়ি আসে তখন সে বাচ্চা। সেই থেকে জয়রামবাবু তাঁকে কন্যাস্নেহে বড় করে তুলেছেন। জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীনপন্থী, মূল্যবোধ সম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষ। তাঁর নিজের পুত্রেরা উপযুক্ত নয়। নিজের কোনো কন্যাসন্তানও ছিল না। তাই বৃদ্ধ জয়রামের অন্তরে কন্যার স্থানটি আদরিণী দখল করে নেয়। তিনি আদরিণীকে সন্তান-নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন। বড় নাতনি কল্যাণীর বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। বৈশাখ মাস পড়লেই উভয়পক্ষের আশীর্বাদ হবে। তখন বাধ্য হয়ে আদরিণীকে বিক্রির জন্য বামুনহাটের মেলায় পাঠিয়ে দেন। কন্যাসমা আদরিণীকে মেলায় পাঠিয়েও তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে তাই লোকজনদের বলেছেন—“একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর, তাতে দাম যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয় সেও স্বীকার।” কথাটির মধ্য দিয়ে জয়রামবাবুর স্নেহার্দ্র মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় যেভাবে পিতা কন্যাকে আশীর্বাদ করে। সেভাবেই তিনি আদরিণীকেও বামুনহাটের মেলায় যাবার সময় মিষ্টিমুখ করিয়েছেন, গায়ে হাত বুলিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু কন্যাকে বিদায় দানের সময় স্নেহশীল পিতা যেভাবে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারেন না, জয়রামও তেমনি আদরিণীকে বিদায় জানাতে পারেননি। আদরিণী মেলায় বিক্রির জন্য চলে যাওয়ার পর তাঁর শোকে বিহ্বল হয়ে ভেঙে পড়ার দৃশ্যটিও কন্যাকে বিদায়ের সময় পিতার শোকের সাথে তুলনা করা চলে।
প্রশ্ন ১২। জয়রাম কীভাবে সাংসারিক অচলাবস্থায় পড়লেন এবং কীভাবে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় করলেন বর্ণনা করো?
উত্তরঃ আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে সম্বল করে যশোর জেলা থেকে শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। জয়রামের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। বলা যায় তিনি নিজের কর্মদক্ষতায় ও পরিশ্রমে একজন সফল মানুষ।
বৃদ্ধ মানুষটি জীবনযুদ্ধে জয়ী হলেও সাংসারিক জীবনে অসফল। পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মে আইন ব্যবসায়ীর দাম নেই। ক্রমশ জয়রামের আয় কমতে থাকল। পূর্বে যা আয় হত এখন তার অর্ধেক হয় কি না সন্দেহ, অথচ খরচ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জয়রামের তিনটি ছেলে। প্রথম দুটি নিরক্ষর, নিষ্কর্মা, নেশাখোর এবং তাসুড়ে। বড় পুত্রটি আবার ‘ফুলুট’ বাজায়। বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কাজ করার যোগ্যতা নেই। একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে–যে কলকাতায় পড়াশুনা করছে। জয়রামের পরাজয় এখানেই। উপার্জনের প্রতি মন দিতে গিয়ে সাংসারিক দিকে দৃষ্টিপাত করেননি।
অবসরের পর জয়রামের সংসার কষ্টে চলতে থাকল। শত চেষ্টাতেও ব্যয় কমাতে পারলেন না। সুদে কুলোয় না বলে মূলধনে হাত পড়তে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিল—তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে না। কিন্তু তাতে জয়রাম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাড়ির সকলের মতো আদরিণীও একজন সদস্যা। সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে আদরিণীকে বিয়ের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে যাতায়াত প্রভৃতি কাজে ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ফলে মাঝে মাঝে ভাড়া হলেও ১৫/২০ টাকার বেশি আয় হল না। এদিকে জয়রামের বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর জন্য প্রতি দিন ৫/৭ টাকা খরচ হতে লাগল। মাসখানেক পরে বালকটি কিছু সুস্থ হল। আবার বড়ো বৌ, মেজ বৌ অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকমাস পরে আরও দুটি মানুষের অন্নসংস্থান করতে হবে। বড় নাতনী কল্যাণীর বারো বৎসর বয়স। তারও বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁর পিতা নির্বিকার। যত দায় এই বৃদ্ধ লোকটির ঘাড়ে। কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন। কোম্পানীর কাগজ কমে আসছে, তা থেকে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া কঠিন। এছাড়া আরও নাতনীরা রয়েছে। তাদের কী হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে জয়রামবাবুর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। একদিন সংবাদ এল ছোট ছেলেটি বি.এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে।
অবশেষে আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে বামুনহাটের মেলায় বিক্রির জন্য আদরিণীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আদরিণীর উপযুক্ত খরিদ্দার না পাওয়ায় মেলা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু অবস্থার পাকচক্রে রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার সময় আদরিণীর কান্নার খবর পেয়ে জয়রামবাবুও কাঁদতে লাগলেন। পরদিন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। জয়রামবাবু খবর পেলেন সাতক্রোশ দূরের একটি জায়গায় আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জয়রামবাবু এই খবরে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লেন যে, তিনি কালবিলম্ব না করে আদরিণীর কাছে ছুটে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আদরিণী মারা গেছে। এর ছয়মাসের মধ্যে জয়রামবাবুও মারা যান।
প্রশ্ন ১৩। “যত দায় এই ষাট বৎসরের বুড়ারই ঘাড়ে।”—ষাট বছরের বুড়োটি কে? তিনি কীরূপ দায়ে পড়েছিলেন?
উত্তরঃ ষাট বছরের বুড়োটি হলেন জয়রাম মুখোপাধ্যায়।
আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে সম্বল করে যশোর জেলা থেকে শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। জয়রামের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। বলা যায় তিনি নিজের কর্মদক্ষতায় ও পরিশ্রমে একজন সফল মানুষ।
বৃদ্ধ মানুষটি জীবনযুদ্ধে জয়ী হলেও সাংসারিক জীবনে অসফল। পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মে আইন ব্যবসায়ীর দাম নেই। ক্রমশ জয়রামের আয় কমতে থাকল। পূর্বে যা আয় হত এখন তার অর্ধেক হয় কি না সন্দেহ, অথচ খরচ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জয়রামের তিনটি ছেলে। প্রথম দুটি নিরক্ষর, নিষ্কর্মা, নেশাখোর এবং তাসুড়ে। বড় পুত্রটি আবার ‘ফুলুট’ বাজায়। বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কাজ করার যোগ্যতা নেই। একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে–যে কলকাতায় পড়াশুনা করছে। জয়রামের পরাজয় এখানেই। উপার্জনের প্রতি মন দিতে গিয়ে সাংসারিক দিকে দৃষ্টিপাত করেননি।
অবসরের পর জয়রামের সংসার কষ্টে চলতে থাকল। শত চেষ্টাতেও ব্যয় কমাতে পারলেন না। সুদে কুলোয় না বলে মূলধনে হাত পড়তে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিল—তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে না। কিন্তু তাতে জয়রাম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাড়ির সকলের মতো আদরিণীও একজন সদস্যা। সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে আদরিণীকে বিয়ের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে যাতায়াত প্রভৃতি কাজে ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ফলে মাঝে মাঝে ভাড়া হলেও ১৫/২০ টাকার বেশি আয় হল না। এদিকে জয়রামের বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর জন্য প্রতি দিন ৫/৭ টাকা খরচ হতে লাগল। মাসখানেক পরে বালকটি কিছু সুস্থ হল। আবার বড়ো বৌ, মেজ বৌ অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকমাস পরে আরও দুটি মানুষের অন্নসংস্থান করতে হবে। বড় নাতনী কল্যাণীর বারো বৎসর বয়স। তারও বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁর পিতা নির্বিকার। যত দায় এই বৃদ্ধ লোকটির ঘাড়ে। কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন। কোম্পানীর কাগজ কমে আসছে, তা থেকে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া কঠিন। এছাড়া আরও নাতনীরা রয়েছে। তাদের কী হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে জয়রামবাবুর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। একদিন সংবাদ এল ছোট ছেলেটি বি.এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে।
অবশেষে আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে বামুনহাটের মেলায় বিক্রির জন্য আদরিণীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আদরিণীর উপযুক্ত খরিদ্দার না পাওয়ায় মেলা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু অবস্থার পাকচক্রে রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার সময় আদরিণীর কান্নার খবর পেয়ে জয়রামবাবুও কাঁদতে লাগলেন। পরদিন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। জয়রামবাবু খবর পেলেন সাতক্রোশ দূরের একটি জায়গায় আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জয়রামবাবু এই খবরে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লেন যে, তিনি কালবিলম্ব না করে আদরিণীর কাছে ছুটে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আদরিণী মারা গেছে। এর ছয়মাসের মধ্যে জয়রামবাবুও মারা যান।
প্রশ্ন ১৪। “দাদামশায় আদর যাবার সময় কাঁদছিল।”—উক্তিটি কার? “আদর” কে? সে কোথায় যাচ্ছিল? আদর যাবার সময় কাঁদছিল কেন?
উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের বড় নাতনী কল্যাণীর।
‘আদর’ হল আদরিণীর ডাক নাম। সে রসুলগঞ্জের মেলার যাচ্ছিল।
মূক প্রাণী মানুষের চোখ ও দেহের ভাষা বোঝে। যারা মনুষ্যেতর প্রাণীদের অপত্যস্নেহে ভালোবাসেন, তারাও জানেন একথা। সেজন্য যখন আদরিণীকে চৈত্র সংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলায় বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন জয়রামবাবু আদরিণীকে মিথ্যে কথা বললেন। তাকে হাট থেকে ঘুরে আসতে বলেন। কিন্তু নিয়তির খেলার কারণে সেখানে সঠিক দাম না মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করা যায়নি। ফলে আবার দ্বিতীয়বার আদরিণীকে পাঠানো হয় রসুলগঞ্জের মেলায়। অসহনীয় বেদনায় এবার জয়রামবাবু আদরিণীকে বিনাবাক্যব্যয়ে বিদায় দিলেন।
যে মর্মান্তিক অনুশোচনায় জয়রামবাবু জ্বলছিলেন, তার আঁচ থেকে কিন্তু তিনি আদরিণীকে দূরে রাখতে পারেননি। কোনো একটি অদৃশ্য চাপের কারণে যে তিনি আদরিণীকে দূরে করে দিচ্ছিলেন, সে কথাটি ওই মূক প্রাণীটি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিল। সেজন্য কথা না বলতে পারা ওই প্রাণীটি রসুলগঞ্জে যাওয়ার সময় নীরবে চোখের জল ফেলার মধ্য দিয়ে সেকথা জানান দিয়ে গিয়েছিল। জয়রামবাবুর কাছ থেকে বিচ্ছেদের কারণে যে আঘাত আদরিণী পেয়েছিল, সে আঘাত মৃত্যুবাণ হয়ে ফিরে এসেছিল আদরিণীর কাছে। বিচ্ছেদের অভিমান আদরিণী সইতে পারেনি। সেজন্য রসুলগঞ্জের পথেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে এবং জয়রামবাবু খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছোনোর আগেই মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
রসুলগঞ্জে যাওয়ার সময় নীরবে চোখের জল ফেলে আদরিণী যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল জয়রামবাবুর দিকে। যেন জিজ্ঞাসা করেছিল—“যদি মনুষ্যেতর প্রাণী না হয়ে মানুষ হতাম, রক্তের সম্পর্কের কেউ হতাম, তাহলে এভাবে পিতা হয়ে কি আমাকে বিক্রি করতে পারতে?” কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের কোনো প্রশ্ন কিন্তু আদরিণী করেনি। সে নিঃশব্দে সরে গিয়েছিল জয়রামবাবুর সমস্যাবহুল জীবন থেকে। কিন্তু সে মরে গিয়ে নিজে মুক্তি লাভ করলেও জয়রামবাবুকে অদ্ভুত এক বন্ধনের মধ্যে রেখে দিয়ে গিয়েছিল। চর্মচক্ষু দিয়ে বাইরে থেকে তাকে দেখা যায় না, কিন্তু হৃদয় দিয়ে তাকে অনুভব করা যায়। তিনি হৃদয় দিয়ে সেটাই অনুভব করেছিলেন।
‘আদরিণী’ গল্পে লেখক তার সুনিপুণ লেখনীর দ্বারা মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যেকার নিবিড় সম্পর্কের চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের মতো প্রত্যক্ষভাবে হয়তো নয়, কিন্তু তাঁর লেখনী পরোক্ষভাবে, অত্যন্ত সুনিপুণ হস্তে হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম তারগুলিকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেজন্য তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা বেদনাময়তার সুরগুলি পাঠক হৃদয়ে বেদনার ঢেউ তুলেছিল।
প্রশ্ন ১৫। “জানতে পেরেছে। ওরা অন্তর্যামী কিনা।”—উক্তিটি কার? ওরা বলতে এখানে কাদের কথা বলা হল? এখানে জানার ব্যাপারটা কী ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের। ওরা বলতে এখানে মূক পশুদের কথা বলা হয়েছে।
জয়রাম মুখুয্যে এবং তার বন্ধুদের সুখ বিলাস ভোগ করার জন্যই হাতিটির সমাদার। এই মনোভাব পশুপ্রীতির নমুনা প্রমাণ করে না। দীর্ঘ পাঁচবছর মোক্তারের বাড়িতেই থেকে যায় ‘আদরিণী’ নামক হাতিটি। দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে গল্পকার মোক্তারের সঙ্গে হাতির ব্যবহারের বাৎসল্যের যে সম্পর্ক সেই চিত্র এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার চিত্র আঁকেননি। মোক্তারের প্রতি হাতির আকৃষ্ট হবার স্বরূপ বোঝা যায় না এই চিত্রের অভাবে। তাছাড়া কোনো প্রমাণচিত্রও মেলে না। কোনো কোনো মানবিক বৃত্তিতে হাতির প্রতি মোক্তারের স্নেহের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে। বিয়ের নিয়ন্ত্রণ সেরে আসার পর পাঁচবছর যাবৎ হাতির স্বভাব, বাসনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্রই এখানে পরিস্ফুট হয়নি। এগুলি যদি থাকত তাহলে হাতির এবং মোক্তারের সম্পর্কের এই যুক্তিটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত। মোক্তার চিরকালের মতো কাছারি বাড়ি ত্যাগ করে আসে, তারপর তার পারিবারিক অর্থনৈতিক সমস্যা ও বিপর্যয় এবং আবার হাতির প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। আর তখনই এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্যই উদ্যোগী হন হাতি বিক্রি করার। তখন গল্পে দ্বিতীয় গুরুত্ব পায় ‘আদরিণী’। আদরিণীর প্রতি মোক্তারের স্নেহার্দ্র হৃদয়ের স্বভাবচিত্র হতে থাকে তখন থেকেই। এইখানেই গল্পকার দুপক্ষের সম্পর্কে বাৎসল্যরস পরিস্ফুট করেছেন। বাজারে হাতি বিক্রির ব্যবস্থা করার সময় তার মনের খবর দু’বার পাওয়া যায়। এই অংশটিতে বারো বছরের জ্যেষ্ঠ পৌত্রী কল্যাণীর কথায়—“দাদামশায় আদর যাবার সময় কাঁদছিল। মুখোপাধ্যায় শুইয়া ছিলেন, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, ‘কি বললি? কাঁদছিল ??
“হ্যাঁ দাদামশায়। যাবার সময় তার চোখ দিয়ে টপ্টপ্ করে জল পড়তে লাগল।”
এই চিত্রে কিছুটা ধরা পড়ে হাতির প্রতিক্রিয়া। মোক্তারের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কথাও জানা যায় এই চিত্রে। “ওরা অন্তর্যামী কিনা। এ বাড়িতে যে আর ফিরে আসবে না, তা জানতে পেরেছে।”
হাতির কান্নার প্রতীকী স্বভাব মধ্যমপুত্রের দ্বারা প্রেরিত চাষীর হাতের একটি চিঠির ভাষায়—
“…আদরিণী অত্যন্ত পীড়িত হইয়া পড়ে। সে আর পথ চলিতে পারে না। রাস্তার পার্শ্বে একটা আমবাগানে শুইয়া পড়িয়াছে। তাহার পেটে বোধহয় কোনও বেদনা হইয়াছে।—শুঁড়টা উঠাইয়া মাঝে মাঝে কাতর স্বরে আর্তনাদ করিয়া উঠিতেছে।”
মোক্তারের প্রতিক্রিয়ায় তার হাতির প্রতি স্নেহার্ড মানবিকতার অসহায়তার দিক দেখতে পাওয়া যায় এই চিত্রে—
“আমার গাড়ির ব্যবস্থা করে দাও। আমি এখন বেরোব। আদরের অসুখ-যাতনায় সে ছটফট করছে। আমাকে না দেখতে পেলে সে সুস্থ হবে না। আর আমি দেরী করতে পারব না।”
…….“বৃদ্ধ ছুটিয়া গিয়া হস্তিনীর শবদেহের নিকট লুটাইয়া পড়িয়া, তাহার মুখের নিকট মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বার বার বলিতে লাগিলেন—“অভিমান করে চলে গেলি মা? তোকে বিক্রি করতে পাঠিয়েছিলাম বলে?—তুই অভিমান করে চলে গেলি?”
কেন্দ্রীয় ভাববস্তু আদরিণী গল্পের অঙ্গীরস যে মমত্ববোধ এবং অসীম পশুপ্রীতি তার একতরফা প্রকাশ পায় গল্পটির মধ্যে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের মহেশ নামক ষাঁড়টি হল গল্পের কাহিনি। রক্তমাংসের স্বভাবে ওতপ্রোত প্লটে এবং আবহে। তর্করত্ন পুরোহিতের হাতে ফলের পুঁটলি দেখে মহেশ আহারের বাসনা জানায় মাথা নাড়িয়ে, সে অন্যের সাজানো বাগানের গাছপালা নষ্ট করে দেয়, দারুণ গ্রীষ্মে তৃষ্ণার্ত মহেশ জলের কলসি ভেঙে দেয় আমিনার— এগুলি সব প্রতীকী হওয়া সত্ত্বেও নায়ক গফুরের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তা অনেক বড়ো তাৎপর্য আনে গল্পের কেন্দ্রীয় রসে। কিন্তু আদরিণী তা করে না।
প্রশ্ন ১৬। আদরিণীর বিদায় পর্বে জয়রাম কী বলে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন?
উত্তরঃ রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে পাঠিয়ে দেওয়ার পর জয়রামবাবু খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কল্যাণী এসে বৃদ্ধকে জানালো “আদর” যাবার আগে কাঁদছিল। শুনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জয়রামবাবু মাটিতে বসে পড়লেন। কল্যাণী চলে গেলে অশ্রুপূর্ণ নয়নে আপন মনে বলতে লাগলেন যে “যাবার সময় আমি তোর সঙ্গে দেখাও করলাম না, সে কি তোকে অনাদর করে? না মা, তা নয়, তুই ত অন্তর্যামী। তুই কি আমার মনের কথা বুঝতে পারিস নি?—খুকীর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর তুই যার ঘরে যাবি, তাদের বাড়ি গিয়ে আমি তোকে দেখে আসব। তোর জন্য সন্দেশ নিয়ে যাব—রসগোল্লা নিয়ে যাব। যতদিন বেঁচে থাকব, তোকে কি ভুলতে পারব? মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে দেখে আসব। তুই মনে কোন অভিমান করিসনে মা।”
পরের দিন বিকালে একজন চাষী লোক আদরিণীর অসুস্থতার সংবাদ লেখা চিঠি এনে দিল। চিঠি পড়ে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মাথায় বজ্রাঘাত হয়। চিঠিতে লেখা আছে বাড়ি থেকে সাত ক্রোশ দূরে আদরিণী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পথ চলতে পারছে না। রাস্তার পাশে আম বাগানে শুয়ে পড়েছে। মাহুত সারারাত চিকিৎসা করেছে, হয়তো আর বাঁচবে না। খবর পাওয়া মাত্রই বৃদ্ধ পাগলের মতো ছুটে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। জয়রামবাবু পৌঁছানোর পূর্বেই অভিমানী আদরিণী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। তারপর জয়রাম মুখোপাধ্যায় মাত্র ছমাস জীবিত ছিলেন।
প্রশ্ন ১৭। “ব্রাহ্মণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল।”—এখানে ব্রাহ্মণ কে? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ এখানে ব্রাহ্মণ বলতে জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে বোঝানো হয়েছে।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আদরিণী’ গল্পটি ছোটো-বড়ো সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এর মধ্যে কোনো পরিচ্ছেদেই জয়রাম মোক্তারের সঙ্গে আদরিণীর আন্তরিক সম্পর্কজনিত কোনো চিত্র আমরা দেখতে পাই না। অথচ জয়রাম মোক্তার আদরিণীর অসুস্থ হওয়ার সংবাদে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আদরিণীর মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। এই চিত্র দেখে অস্বাভাবিক লাগতেই পারে, কারণ আদরিণী গল্পের কাঠামো এবং বিন্যাসে জয়রাম মোক্তারের সঙ্গে আদরিণীর স্নেহমায়াজনিত সম্পর্কের কোনোরকম চিত্র আসা স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য এখানে আসেনি, এই না-আসা ব্যাপারটা কি লেখকের ইচ্ছাধীন না গল্পের কাঠামোর মূল দুর্বলতা?
জয়রাম নিজের অহংকার চরিতার্থ করতে কিনেছিলেন আদরিণীকে। পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ির বিবাহের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে মহারাজা শ্রীনরেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর কাছে একটি হাতি প্রার্থনা করেছিলেন জয়রাম। কিন্তু যখন মহারাজ প্রত্যাখ্যান করলেন তাঁর অনুরোধ এবং দেওয়ানজী দিয়ে বলে পাঠালেন “বিয়ের নেমন্তন্ন হয়েছে তার জন্য হাতি কেন? গরুর গাড়িতে আসতে ‘রোলো’।” সেই কথা শুনে লজ্জায়, রাগে, ক্ষোভে জয়রাম একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই জয়রাম হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন দু-হাজার টাকা দিয়ে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সদ্য কেনা হাতি আদরিণীকে দেখানো এবং অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া।
লেখক গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদেই আদরিণীকে কেনার প্রেক্ষাপট এবং জয়রাম মোক্তারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। জয়রামের আর্থিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। আর্থিক অনটনের জন্য তাঁর হিতাকাঙ্খীরা তার আদরিণীকে বিক্রি করে দেবার জন্য জয়রামকে বলেছিলেন। এ প্রস্তাবে জয়রাম রাজি হননি।
দীর্ঘ পাঁচবছরের আদরিণীর সঙ্গে জয়রামের সম্পর্ক শুধু পশু এবং প্রতিপালকের সম্পর্ক নয়, একটি আন্তরিক সম্পর্কও প্রবাহিত হয়েছে ফল্গুধারার মতো। শেষ পর্যন্ত এই প্রবাহ এক গভীর পারিবারিক বন্ধনে গিয়ে পৌঁছেছে।
আদরিণীকে বামুনহাটের মেলায় এবং রসুলগঞ্জের মেলায় পাঠাবার ঘটনার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক। যখন আর্থিক অভাবে পড়ে বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে আদরিণীকে বামুনহাটের মেলায় পাঠাতে মনস্থ করেন। আদরিণীকে মেলাতে পাঠাবার আগে জয়রাম নিজের হাতে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন। সবশেষে তিনি ভাঙা গলায় আদর করতে করতে বলেছিলেন— “আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।” এরপর মাত্র দুটি লাইনেই জয়রামের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়—“প্রাণে ধরিয়া বিদায় বাণী উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। উদ্বেল দুঃখে এই ছলনাটুকুর আশ্রয় লইলেন।”
আদরিণীকে রসুলগঞ্জের মেলায় পাঠাবার সময় জয়রাম এই ছলনাটুকুরও পুর্নবার আশ্রয় নেননি। তিনি আদরিণীর সামনেও যাননি। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেনম—“জানতে পেরেছে এ বাড়ীতে যে আর ফিরে আসবে না, জানতে পেরেছে।”
আদরিণীর মৃত্যুতে বোঝা যায় যে জয়রাম ও আদরিণীর মানসিক সম্পর্ক কতখানি ছিল। আদরিণীর মৃত্যুতে জয়রামের শোকে কাতর হয়ে পড়া আর অস্বাভাবিক লাগে না। গল্পটি সার্থক হয়ে ওঠে এখানে। আদরিণীর মৃত্যুর ঠিক দুমাস পরেই জয়রামের মৃত্যু হয়।
ব্যাকরণ
সমাস :-
জরামৃত্যু — জরা ও মৃত্যু (দ্বন্দ্ব সমাস)।
পাপপুণ্য — পাপ ও পুণ্য (দ্বন্দ্ব সমাস)।
সদস্য — দলের সভ্য যে (উপপদ তৎপুরুষ)।
জ্ঞানতরু — জ্ঞানের যে তরু (কর্মধারয়)।
বিষতরু — বিষের যে তরু (কর্মধারয়)।
জ্ঞানালোক — জ্ঞানের যে আলোক (কর্মধারয়)।
জন্মান্ধ — জন্ম থেকে অন্ধ যে (উপপদ তৎপুরুষ)।
শতাব্দী — একশত বর্ষব্যাপী যে কাল (কর্মধারয়)।
বিপরীত শব্দ :-
জরা — যৌবন।
মৃত্যু — জন্ম।
তুষ্ট — অসন্তুষ্ট।
জ্ঞান — অজ্ঞান।
পুরোহিত — যজমান।
অলীক — বাস্তব।
নিৰ্ভীকতা — ভয়যুক্ত।
অন্ধ — দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন।
সুন্দর — কুৎসিত।
অতীত — বর্তমান।
অশুদ্ধি সংশোধন :-
উজ্জল — উজ্জ্বল।
সৌন্দৰ্য্য — সৌন্দর্য।
তোষন — তোষণ।
অপরাহ্ন — অপরাহ্ণ।
সদ্যজাত — সদ্যোজাত।
নিচের শব্দগুলো প্রসারিত করে লেখো।
অননুভূতপূর্ব — অনুভূত হওয়ার পূর্বে।
সদ্যোজাত — সবে জন্মগ্রহণ করেছে যে।
অধীত — অধ্যয়ন করা হয়েছে এমন।
জন্মান্ধ — জন্ম থেকে অন্ধ।
অদূরদর্শিতা — দূর বা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে কাজ করা।
কুলীন — কুলে (বংশে) জন্মায় যে।
হীনম্মন্যতা — হীন চিন্তাভাবনা যার মনে কাজ করে।
Hi! I’m Ankit Roy, a full time blogger, digital marketer and Founder of Roy Library. I shall provide you all kinds of study materials, including Notes, Suggestions, Biographies and everything you need.