Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ

Join Roy Library Telegram Groups

Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ Provided by The Roy Library is one of the best content available on the internet as well as many other offline books. Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ Question Answer is made for Assam Seba Board students. Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ We ensure that You can completely trust this content. If you learn PDF from then you can Scroll Down and buy PDF text book Solutions I hope You Can learn Better Knowledge.

Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ

Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ Here we will provide you complete Bengali Medium SEBA Class 10 Bengali Byakoron Suggestion, SEBA Class 10 Bengali Byakoron Question Answer, SEBA Class 10 Bengali Byakoron Notes, SEBA Class 10 Bengali Byakoron Solution, Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ Question Answer absolutely free of cost. Class 10 Grammar | দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ | মাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ সাজেশন, দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ pdf, দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ বই, বাংলা ব্যাকরণ বোর্ড বই, বাংলা ব্যাকরণ প্রশ্ন pdf, দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ কারক, দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ সমাস, দশম শ্রেণির ব্যাকরণ, If you read this solution very carefully with proper understanding & then memorize questions by yourself you can score the maximum number of marks in your upcoming Exam.

ব্যাকরণ

ভাবসম্প্রসারণ 

“যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,

যখনি জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।”

উত্তরঃ শক্তির দত্তে কখনও কখনও মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষকে পীড়ন করে, অত্যাচার করে শক্তিমান এক ধরনের তৃপ্তি লাভ করে। যদিও সে মনে মনে জানে, অসহায় দুর্বল মানুষের প্রতি এক নিষ্ঠুর আচরণ অন্যায় ও অসঙ্গত। তথাপি সে পেশী প্রদর্শনে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্বল হলেও সব মানুষের সহ্যের সীমা আছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে একদিন সে মরীয়া হয়ে ওঠে। বাঁচার জন্য সে প্রত্যাঘাত করে। সর্বশক্তি দিয়ে সে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আর তখনই অত্যাচারী ভীত হয়, পালানোর পথ খোঁজে।

ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত করেছে এ ঘটনার। একদা দুর্বল, অত্যাচারিত ভীষণ আক্রমণাত্মক হয়ে সবলকে পর্যুদস্ত করেছে– এ নজির আমরা সর্বত্র দেখেছি। আমরা জানি–

“পায়ের তলার ধূলা, সেও যদি কেউ পদাঘাত করে।

তখনই সে লয় প্রতিশোধ, চড়ি তার শিরোপরে।”

পথের নগণ্য ধূলাও পদাঘাতের সমুচিত জবাব দিয়ে থাকে। আর মানুষ দরিদ্র বলে, অসহায় বলে চিরকাল অবজ্ঞা বা ঘৃণার পাত্র হবে, লাঞ্ছনার শিকার হবে— এ ধারণা যারা করে থাকে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে। দুর্বল অক্ষমও প্রত্যাঘাত করতে জানে, এবং সে প্রত্যাঘাত অতি ভয়ঙ্কর, অতি ভীষণ। তাই সুস্থ বুদ্ধি যাদের আছে তারা নিজেরা সুন্দরভাবে বাঁচে এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য করে। অসহায়ের প্রতি নির্মম হয় না, দুর্বলকে আঘাত করে না, পরিবর্তে তাদের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে।

“জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে।

সে জাতির নাম মানব জাতি

এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত,

একই রবি শশী মোদের সাথী।”

উত্তরঃ দেশ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম-সংস্কার প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে মানুষ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। আমরা ভুলে যাই পৃথিবী আমাদের জননী—‘বসুধৈব কুটুম্বকম্। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পরিবর্তে খণ্ড খণ্ড প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষে আমরা জর্জরিত হই। ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। তাঁর উদার আকাশের নীচে চন্দ্রালোকিত, সূর্যকিরণদীপ্ত ধরণীর বুকে লালিত-পালিত সকল মানুষের প্রতি তাঁর সমান দৃষ্টি। পৃথিবীর উৎপন্ন শস্যে মানুষের ক্ষুধার নিবৃত্তি। ‘বিশ্বমায়ের বিশ্বময়ীর’ অঞ্চলে বেড়ে-ওঠা সন্তানরা কিন্তু একটু বড় হবার পরই স্বার্থান্ধ হয়ে ওঠে। সংকীর্ণ আত্মপরতার মোহে বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর তোলে। হৃদয়ের ঐশ্বর্য, প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা বিস্মৃত হয়ে একে অন্যকে হেয় করতে থাকে। ক্রমশ তার পাশব প্রবৃত্তিগুলি জেগে উঠে ভেদবুদ্ধির শিকার হয়ে অপমান করে নিজেকে।

কিন্তু মানুষ হল ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’। ক্ষণিকের ভ্রান্তি অপগত হলেই সে আত্মস্বরূপকে উপলব্ধি করে। ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ গড়ার শুভ সংকল্প নিয়ে সে সমগ্র মানব জাতির উন্নয়ন-সাধনে ব্রতী হয়। সমগ্র মানবের কল্যাণ ব্যক্তির মঙ্গলকে ঘিরেই সূচিত হয়। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ করতেন সারা পৃথিবীর হিত-কামনায়। পৃথিবীর আবহাওয়া দূষণমুক্ত হবে। যেখানে মানব গোষ্ঠীর বাস, তারা পবিত্র নিঃশ্বাসগ্রহণে সুস্থ থাকবে এই ছিল তাঁদের ঐকান্তিক কামনা। আজ বিজ্ঞান সমস্ত দূরত্বকে সরিয়ে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সংযোগ রক্ষা করেছে। এখন প্রয়োজন সর্বপ্রকারের উগ্র স্বাদেশিকতাকে বর্জন করে, ভেদবুদ্ধিকে দূরে ঠেলে সেই বোধে উন্নীত হওয়া যা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরদেশে নিয়ে যাবে। প্রমাণ করবে—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে

সহস্ৰ শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে ;

যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়

পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”

উত্তরঃ নদী স্রোতস্বিনী, গতিময়ী, দুর্বার গতিতে সে এগিয়ে চলেছে বৃহতের লক্ষ্যে, সমুদ্রের অভিমুখে। জীবনের সাথে নদীর রয়েছে নিবিড় সাদৃশ্য। জীবনও চিরচলিষ্ণু। এই চলমানতা বা গতিশীলতা আছে বলেই জীবন নানা রূপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে পূর্ণতার লক্ষ্যে। জীবনের গতি যখনই স্তব্ধ হয়ে যায়, তখনই ঘনিয়ে আসে তার অন্তিম লগ্ন। মৃত্যুর করাল গ্রাস জীবনকে লেহন করে নেয়। একথা শুধু ব্যক্তি সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়, সমানভাবে একথা সমষ্টি জীবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমাজের গতিশীলতা স্তব্ধ হয়ে গেলে জীবনের স্বচ্ছন্দ প্রবাহও ব্যাহত হয়। স্রোত না বইলে নদী যেমন শৈবাল দ্বারা সমাকীর্ণ হয়ে স্তব্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, তেমনই জাতির জীবনে নতুনকে গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে গেলে জাতির জীবন পঙ্গু হয়ে যায়। রক্ষণশীলতার বদ্ধ মনোভূমিতে পাপ প্রবেশ করে, কুসংস্কার গলা টিপে ধরে, অনাচার পঙ্কিলতা স্থবির করে দেয়। বিনষ্টির সংকেত বহন করে নিয়ে আসে।

8

প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন

ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।

ধিক্ ধিক্ করে তারে কাননে, সবাই,

সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ, ভাই?

উত্তরঃ ক্ষুদ্রের গৌরব স্বীকার করার মতো মানসিকতা খুব অল্প লোকেরই থাকে। উদার হৃদয় মহৎ ব্যক্তি না হলে ক্ষুদ্র মানুষের গৌরব স্বীকার করতে পারে না। একটি কাননের রূপকের মাধ্যমে এই মহৎ সত্যটিকে কবি এই কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এখানে বর্ণিত দৃশ্যপটে রয়েছে প্রাচীর ঘেরা একটি কানন। কানন যখন, তখন এখানে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। রয়েছে নানান ধরনের ফুল। প্রাচীরের গায়েও রয়েছে নানা আগাছা এবং তাদের ছোটো ছোটো ফুল। এইরকম একটি পরিবেশে হঠাৎ ছোট্ট একটি ফুল ফুটল প্রাচীরের ছিদ্রে। ফুলটি ছোটো, কিন্তু সুন্দর। তবে সুন্দর হলে কী হবে, এর তেমন রাজসিক নামডাক নেই। বরং তাকে নামগোত্রহীন বলাই চলে। এই দীনহীন ছোট্ট ফুলটিকে, নামগোত্রহীন এবং ক্ষুদ্রতার জন্য কাননের সকলেই ধিকৃত করছে। সকলেই করছে ছি-ছি। সে যে একটি ফুল, সেটুকু স্বীকৃতিও সে পাচ্ছে না। প্রাচীরের ছিদ্রে ফুটেছে বলে সে পাচ্ছে শুধু সকলের অবজ্ঞা। এইরকম যখন অবস্থা, ঠিক সেই সময় সূর্য উঠল। সূর্যের আলো এই ফুলটির ওপরও পড়ল এবং তাঁকে ভ্রাতৃ সম্বোধনে সূর্য কুশল জিজ্ঞাসা করল, ভালো আছ ভাই? মহৎ ব্যক্তিরা এইভাবেই সকলকে গ্রহণ করেন—ক্ষুদ্রের গৌরবকেও তাঁরা সাদরে স্বীকৃতি দেন। অবজ্ঞা করেন না। মহৎ ব্যক্তি কেন যে ‘মহৎ, এই ধরনের আচরণেই ধরা পড়ে।

অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।

উত্তরঃ অন্যায়ের মতো কুৎসিত ব্যাপার আর কিছুই নেই। কুৎসিত জিনিসকে আমরা যেমন ঘৃণা করি, অন্যায়কেও তেমনি আমাদের ঘৃণা করা উচিত। অন্যায়কে কেন ঘৃণ্য বলে কবি ঘোষণা করেছেন, তার তাৎপর্যটাও আমাদের বোঝা দরকার। যেকাজে ন্যায় ধর্মের অনুমাত্র অনুসরণ নেই, তাকেই বলে ‘অন্যায়’। ‘ন্যায়’কে লঙ্ঘন করেই ‘অন্যায়ের’ রবরবা। কোনোরকম নীতির ধার ধারে না এই অন্যায়। এবং একটু খতিয়ে দেখলে যা জানা যায়, তা হল প্রবলরা তাদের ঔদ্ধত্য প্রকাশের জন্যই এই হাতিয়ারটি বেছে নেয়। ওই প্রবলরা হল স্বৈরতন্ত্রী। কোনো নীতি ধর্ম বা কোনো যুক্তির ধার এরা ধারে না। দুর্বলদের ওপর এই হাতিয়ারটি প্রয়োগ করে তারা তাদের খেয়াল ও স্বার্থ চরিতার্থ করে থাকে। এই হঠকারীরা সমাজের ঘোরতর শত্রু। এরা নিজেদের প্রভাব অটুট রাখার জন্য সমাজের সর্বস্তরে সুন্দরভাবে জাল বিছিয়ে রাখে। তাই অন্যায়ের প্রতিকার হয় না। দরজার দরজা ন্যায়সংগত দাবি ও বিচার চেয়ে যুগযুগ ধরে এরা ফিরে আসে। পরিবর্তে শোনা যায় অন্যায়ের অট্টহাসি। মোটকথা, এটি একটি কুৎসিত ষড়যন্ত্র, সুতরাং সর্ব্বৈ ঘৃণ্য। অন্যায় যে করে, সেই অন্যায়কারীকে প্রতিরোধ করা দরকার। কিছু না পারলে অন্তত ঘৃণা করা দরকার। এই অন্যায়কারীর সঙ্গে আর একজনকে সমানভাবে ঘৃণা করা দরকার, যিনি অন্যায় সহ্য করছেন। অন্যায়ে নির্যাতিত হলেও, সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করাই হল অন্যায়কে হঠানোর সেরা পথ। আর দূরে দাঁড়িয়ে অন্যায়কারী ও অন্যায়পিষ্ট পীড়িতকে চোখের সামনে দেখেও যিনি নিজেকে নিরপেক্ষ করে রাখেন, তিনিও সমান ঘৃণ্য। কবির ভাষায়, আমাদের ঘৃণা এই ধরনের মানুষদের যেন তৃণের মতো পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,

‘আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কিরে?’

থলি বলে, ‘কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে

আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।’

উত্তরঃ আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের একটি অসংগতির কথা এই কবিতার ভেতর দিয়ে আশ্চর্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা অর্থ বা টাকাকড়িকেই সাধারণত চরম মূল্য দিয়ে থাকি। এমনকি আমাদের আত্মীয় কুটুম্বিতার যে উষ্ণতা, তাও নির্ভর করে এই অর্থ কৌলীন্যের ওপর। যে আত্মীয় ধনী, সে তার দরিদ্র আত্মীয়কে সমাদর করে না। কাছে টানে না। এমনকি আত্মীয় বলে অনেক সময় পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত হয়। এদিকে দরিদ্র আত্মীয়টি কিছুতেই কিন্তু ভুলতে পারে না তার ধনী আত্মীয়ের কথা। সে ওই আত্মীয়ের কাছে নানা ছলছুতায় পৌঁছুতে চায়। বলা বাহুল্য, এই বৈপরীত্য তৈরির জন্য দায়ী হল অর্থ।—এই কবিতাটিতে রূপকের মাধ্যমে কবি এই কথাই বলেছেন। ‘ঝুলি’ এবং ‘থলি’ দুজনেই একই আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। তবে ঝুলিটি হল ভিক্ষার এবং থলিটি হল টাকার। টাকার থলিকে আত্মীয় সম্বোধন করে একটি কথা জানতে চেয়েছিল ভিক্ষার ঝুলি, সে কথাটি হল, ‘থলি’ কি ভুলে গেল ‘ঝুলি’র সঙ্গে আত্মীয়তার কথা!—বড়োলোক আত্মীয়কে দরিদ্র আত্মীয় যেম. বলে থাকেন, এই সম্বোধন অবিকল ঠিক তেমনি। বলাবাহুল্য, থলি তার উত্তরটা বড়োলোক আত্মীয়ের মতনই দিয়েছিল। বলেছিল যে ঝুলি বেচারিও তার আত্মীয়তার কথা ভুলে যেত যদি টাকা-রূপ বিত্তটি তার কাছে না থেকে, থাকত ওই ঝুলির ভেতর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্যে দিয়ে সেই অমোঘ সত্যটিই প্রকাশিত হল যে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠি হল ‘অর্থ’। এই অর্থের জন্যই গড়ে ওঠে বা ভেঙে যায় আত্মীয়তা ও কুটুম্বিতা। তফাত হয়, ‘ঝুলি’র সঙ্গে ‘থলি’র সম্পর্ক।

স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ

বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে।

উত্তরঃ সবাই ঠিকমতো বাঁচতে জানে না। বাঁচা মানে, কেবল টিকে থাকা নয়। পশুদের বেঁচে থাকার সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার সংজ্ঞা মেলে না, ঠিক অনুরূপভাবেই টিকে থাকার ব্যাপারটির সঙ্গে বেঁচে থাকার বিষয়টিও মেলে না। বেশিরভাগ মানুষ স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ হলেই তারা খুশি।—নিজের খাওয়া নিজের পরা এবং নিজের সুখের সীমিত গণ্ডির ভেতরেই তাঁরা বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। বলা বাহুল্য, এটি বাঁচা নয়। আমাদের পরিবার-পরিজনের বাইরে যে বৃহৎ জগৎ রয়েছে, তাদের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হবে। তাদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দের সঙ্গে নিজেকে শামিল করা দরকার। নতুবা বাঁচার সুখ পাওয়া যায় না। ব্যক্তি-স্বার্থের সঙ্গে বিশ্ব-স্বার্থের গরমিল প্রচুর। ব্যক্তি-স্বার্থের গণ্ডি কেটে বেরিয়ে না আসতে পারলে বিশ্ব-স্বার্থের সঙ্গে যোগ সম্ভব হয় না। ব্যক্তি সুখ এবং ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা কখনওই পূর্ণ হয় না, যদি না আমরা নিজেদের বৃহৎ জগতের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করি। পক্ষান্তরে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে আমাদের বেঁচে থাকার নতুনতর একটি তাৎপর্য পাওয়া যায়। প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে নতুনতর সম্পর্ক। অপরের অভাবের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে হয় নিজেদের ক্ষুদ্র অভাবের কথা। অপরের দুঃখ, বেদনা এবং বিপন্নতা এমনি করেই কেড়ে নিতে পারে আমাদের ব্যক্তিগত দুঃখ, বেদনা এবং বিপন্নতা। ঠিক এইভাবেই বৃহত্তর জগতের সুখে আমরা সুখীও হতে পারি।—বলা বাহুল্য, বেঁচে থাকার এই আনন্দময় রহস্যটি কবি আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছেন বলেই তিনি জোরের সঙ্গে বলতে পেরেছেন, স্বার্থপর ব্যক্তিরা, যাঁরা বৃহৎ জগতের দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন, তাঁরা বাঁচতে শেখেননি।

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির—

লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।

উত্তরঃ জলভরা বিশাল দিঘি। এ দিঘির আর এক নাম জলাশয়। এই জলাশয় বৃষ্টিতে ভরে, শিশিরে নয়। এই দিঘির কোলেই জমে রয়েছে শ্যাওলা।—এই জলের কোলেই জন্মেছে বলে শ্যাওলার অস্তিত্ব, নতুবা তার জন্ম বা টিকে থাকা আদৌ সম্ভব হত না। –এই শ্যাওলা একটি কাণ্ড করে বসেছে। তার গায়ে যে শিশির পড়েছে সেই শিশিরের একফোঁটা দিঘিকে দান করেছে। এই দান করে সে খুবই গর্ব অনুভব করেছে এবং ঘাড় উঁচু করে দিঘিকে ডেকে বলেছে যে তার এই দানটুকু লিখে রাখতে। কবিতার মধ্য দিয়ে লেখক যদিচ এই কথাটিকে বলেছেন, কিন্তু অনুধাবন করলে বোঝা যায় কবির বক্তব্য এখানেই শেষ হয়নি। তিনি শৈবাল ও দিঘির রূপকের মধ্য দিয়ে আমাদের মানবচরিত্রের বিশেষ একটি দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন। দিঘির মতো মহাশয় চরিত্রের মানুষ আমাদের চোখে সচরাচর পড়ে না। কিন্তু শ্যাওলার মতো গর্বোদ্ধত নীচু মাপের মানুষদের আমরা হামেশাই দেখতে পাই। দিঘির মতো মহাশয় মানুষদের কল্যাণে, তাঁদের আশ্রয়ে অনেক শ্যাওলা-সদৃশ ব্যক্তি টিকে রয়েছেন। এই ব্যক্তিদের প্রত্যুপকার করবার কোনো ক্ষমতাই ‘শ্যাওলা মানুষ’দের নেই। তবু কখনো কখনো যদি এক ফোঁটা উপকার করে বসেন, তখন দেমাকে তাঁদের পা আর মাটিতে পড়ে না। দিঘির মত মহাশয় মানুষরা নীরবে বহু লোকের বহু উপকার করে চলেছেন। এর জন্য কোনো ঢক্কা-নিনাদ বা প্রচার নেই। পক্ষান্তরে সংকীর্ণমনা শৈবাল-সদৃশ ব্যক্তিরা একফোঁটা উপকার করেই চান নাম কিনতে। চান প্রচার।—বলার অপেক্ষা রাখে না, নীচ ব্যক্তির দান এরকমই হয়ে থাকে। দিঘির জলেও একফোঁটা শিশির দিয়ে শ্যাওলা চায় দাতার স্বীকৃতি।—এটাই হল সবথেকে কৌতুকের।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে

বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে

রণিবে না,

বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব

শান্ত।

উত্তরঃ প্রাচীন যুগ থেকে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার দেখতে পাওয়া যায়। লক্ষ কোটি জনগণের উপর নানারকম শাসন ও শোষণের রথচক্র কবিকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। জীবনের প্রতিপদে তিনি দেখছেন নিপীড়নের শৃঙ্খল। লৌহকপাটের আড়ালে তাদের মর্মবাণী নিষ্ফল আক্রোশে মরছে। সারা দেশ একটা বিশাল কারাগারে পরিণত হয়েছে। নিরীহ দুর্বল মানুষের রক্তে সবলেরা উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করেছে, এইসব অত্যাচারের মুখে বিদ্রোহী কবি নীরব থাকতে পারেননি। তিনি সকলকে সর্বশক্তি দিয়ে এই অনাচারের উৎসকে দমন করতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাই কবি অঙ্গীকার করছেন, যতদিন পৃথিবীতে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশ বাতাস ধ্বনিত করবে, যতদিন অত্যাচারীর বজ্রকৃপাণে রণঝংকার শোনা যাবে, ততদিন তিনি বিশ্রাম নেবেন না। অত্যাচারের অবসান ঘটাতে কবি নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত নন। যেদিন পৃথিবী থেকে অত্যাচারের শেষ চিহ্নটি বিলুপ্ত হবে, সেইদিন কবি স্বস্তি লাভ করবেন ও বিশ্রাম নেবেন। তার আগে নয়।

১০

যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ

কেহ কভু তাহাদের করেনি সম্মান।

উত্তরঃ সমস্ত জীবেরই জন্মমৃত্যু রয়েছে। এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলে একদিন তার মৃত্যু হবেই। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। মৃত্যুই হল জীবনের শেষ পরিণাম। সেই জন্য এই মৃত্যুর মধ্যে কোনো গৌরব বা মাহাত্ম্য নেই। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যখন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তার প্রাণ বিসর্জন দেয়, তখন সেই মৃত্যু হয়ে ওঠে আদর্শের গৌরবে মহিমান্বিত। আর যে ব্যক্তি সাধারণভাবে তার আয়ুষ্কাল শেষ করে মারা যায়, তার কথা কখনও কেউ মনে রাখে না। কিন্তু ওই মানুষটি যদি কোনো মহৎ কর্ম বা পরোপকারের মাধ্যমে তার জীবন বিসর্জন দিত, তাহলে তাকে সবাই মানবপ্রেমিক বলে সম্মান জানাত। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের পরাধীনতার সময়ের কথা বলা যেতে পারে। তখন অনেকে প্রাকৃতিক নিয়মে মারা গিয়েছেন তাঁদের কথা কারও মনে নেই। কিন্তু যাঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের কথা বর্তমানে সবাই স্মরণ করে থাকে। তাদের নাম চিরকাল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। সুতরাং কোনো মহৎ কার্য সাধন করতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দিয়ে সকলের স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত।

১১

যারা এ জীবনে হয়েছে সর্বহারা

পরের জন্য তারা তবু রয় খাড়া।

উত্তরঃ পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সবরকম স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পরের মঙ্গল সাধনে যত্নবান থাকেন। দেখা যায় হয়তো তাঁরা এতে কোনো সার্থকতা লাভ করতে পারেন না অথবা অর্থ যশ প্রতিপত্তি এবং সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায় তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন হয়তো রোগে-শোকে পরিপূর্ণ, তথাপি তাঁরা কখনও পরোপকার থেকে বিরত থাকে না। যাদের পেটে অন্ন থাকে না, মাথা গুঁজবার ঠাঁই থাকে না, স্ত্রী-পুত্র পরিজনাদি থাকে না, তাদের সর্বহারা বলা হয়। এই সর্বহারা মানবিক অধিকার থেকে কখনও কিন্তু বঞ্চিত নয়। তাই অনেক সময় দেখা যায় সর্বহারার দলই সর্বহারার বেদনা বুঝতে পারে। তাই তারা পরের দুঃখ দূর করার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট থাকে। দারিদ্র্যের নিপীড়ন জ্বালা তাদের মনোবল নষ্ট করতে পারে না। তারা সর্বহারার দুঃখ যেমন মর্ম দিয়ে অনুভব করতে পারে এমন আর কেউই পারে না। তাই অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, যারা জীবনে সর্বহারা তারাই অপরের বিপদের সময় এসে উপস্থিত হয়।

১২

“মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়,

আড়ালে তার সূর্য হাসে;

হারা শশীর হারা হাসি

অন্ধকারেই ফিরে আসে।”

উত্তরঃ জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। এগিয়ে যাবার পথে অনেক বাধা, অনেক বিঘ্ন। কিন্তু তাই বলে তো থেমে থাকা যায় না, এগিয়ে যেতে হবে সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে। ভাল কাজ করতে গেলে, অসংখ্য বাধা-বিঘ্ন এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়, কিন্তু দুর্জয় সাহসে ভর করে যে যোদ্ধার মতো যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যেতে পারে, জয় হয় তারই, সাফল্য আসে তারই। সুখ-দুঃখের সমন্বয়েই মানবজীবন। সুখের পর দুঃখ, আবার দুঃখের পর সুখ চক্রের মতো ঘুরছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সুখ-দুঃখ পর্যায়ক্রমে মানবজীবনে উপস্থিত হয়। মেঘ করলে সূর্য ঢাকা পড়ে, অন্ধকার হয়ে আসে। পরক্ষণে বৃষ্টিপাত হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। আবার সূর্য হাসতে থাকে বা কিরণ দিতে থাকে। কখনো বা জোরালো বাতাসের তাড়নায় মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়। আবার দেখা যায় সূর্যকে, আবার আলোয় ভরে ওঠে পৃথিবী। তেমনই দুঃসময় এসে জীবনকে করে তোলে অন্ধকারময়। আবার তা দূরে সরে যায়, আসে সুসময়, কান্না পরিণত হয় হাসিতে। নিশি অবসানে আমরা হারাই চাঁদকে, তার হাসিকে। কিন্তু রাত্রি সমাগমে চতুর্দিক যখন ভরে ব্লায় অন্ধকারে, তখন আকাশে দেখা যায় চাঁদ আর তার হাসি। পৃথিবী ভরে ওঠে স্নিগ্ধ আলোয়। মানুষের জীবনও প্রাকৃতিক এই নিয়মে বাঁধা। সুখ বা দুঃখ কোনোটাই স্থায়ী নয়। এই জগতের সব কিছুই পরিবর্তনশীল। কবিগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবিতার মাধ্যমে মানুষকে এই কথাই শুনিয়েছেন। সুতরাং সুখ বা দুঃখ কারো কাছেই আত্মসমর্পণ না করে নিজ কর্তব্যে অচল অটল থেকে এগিয়ে যেতে হবে আপন লক্ষ্যাভিমুখে।

১৩

“বন্ধু, তোমার বুকভরা লোভ,

দু চোখে স্বার্থঠুলি,

নতুবা দেখিতে তোমারে সেবিতে

দেবতা হয়েছে কুলী।”

উত্তরঃ অধিকাংশ মানুষের জীবনই নানা বাসনা-কামনা-স্বার্থসিদ্ধির চিন্তায় বিভোর। তাই জগতের প্রকৃত রহস্য তার কাছে উন্মোচিত হয় না। মিথ্যাকে আশ্রয় করে সত্য থেকে বহুদূরে সে নির্বাসিত। ঈশ্বর স্বয়ং এই জীবজগতের আবরণে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে সব কিছুই করছেন—এই সত্য সাধারণ মানুষের অজ্ঞাত। সে লোভ-লালসার আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খায়, বাসনা-কামনার পশ্চাতে ছুটে বেড়ায় আলেয়ার পেছনে ছোটার মতো। কবির ভাষায়—’যাহা চাই তাহা পাই না।’ সুতরাং দুঃখ-আঘাত অবশ্যম্ভাবী। মানুষের সমূহ দুঃখ-দুর্গতির মূল কারণ বাসনা-কামনা, যা পূরণ হবার নয়। তবুও তার পিছনে ছোটারও বিরাম নেই। এইভাবেই কাটে মানুষের জীবন। সহসা একদিন যমদূত এসে বলে ‘সময় হয়েছে, চলো।’ দারুণ মায়া-মমতা, পার্থিব বস্তুতে প্রবল আসক্তি থাকা সত্ত্বেও সে যেতে বাধ্য হয়। ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অল্প। কঠোর সাধনায় জগত্রহস্য ভেদ করে সত্যকে যাঁরা উপলব্ধি করেছেন, তাঁদের আমরা মহাপুরুষ, অবতার পুরুষ, পরম পুরুষ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করি। যীশু, বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ—এঁরা সত্যদ্রষ্টা, তাই এঁরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতেন না, ঈশ্বর মানুষের বেশ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তা তাঁরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করেছিলেন। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন অথবা মানবরূপ ধারণ করে আছেন। আবার চাকর, কুলী, মেথর প্রভৃতি বৃত্তি অবলম্বন করে মানুষের সেবা করছেন। কিন্তু এই সত্য জানবার জন্য স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিতে হবে, লোভ-লালসাকে জয় করতে হবে। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতাই জ্ঞানলাভের অন্তরায়। এইসব প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারলে মানুষ সত্যের সন্ধান পায়, তখন আর তার কোনো দুঃখই থাকে না।

১৪

“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক

কে বলে তা বহুদূর ?

মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক

মানুষেতে সুরাসুর।”

উত্তরঃ আমাদের ধারণা পৃথিবী থেকে বহু ঊর্ধ্বে আছে দেবতাদের বাসভূমি —স্বর্গলোক, আবার অনেক নিম্নে আছে অশরীরী মৃত মানুষের অপরাধের শাস্তিভূমি নরক। কিন্তু এ আমাদের কল্পনামাত্র। মানুষের মধ্যেই স্বর্গ আছে, আবার নরকও আছে। শান্তিপ্রিয় পরোপকারী হিংসাদ্বেষমুক্ত সংস্কারমুক্ত উদার বিশালহৃদয় মানুষের মধ্যেই আছে স্বর্গ, আবার লোভী স্বার্থপর হিংসাদ্বেষপ্রবণ সমাজবিরোধী মানুষের মধ্যেই আছে নরক। সদ্গুণাবলীর অধিকারী নিঃস্বার্থ নির্লোভ পরহিতৈষী মানুষের মধ্যে বসে করেন দেবতা। আবার লোভী স্বার্থপর ভোগবাদী অত্যাচারী মানুষের মধ্যে বাস করে অসুর বা দানব। এই পৃথিবীতে উক্ত দু’রকম মানুষই দেখতে পাওয়া যায়। যদিও দেবভাবসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বিরল। স্বীয় কৃতকর্মের ফলে মানুষ এখানেই সুখ-শান্তি আবার দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। সুতরাং মানুষ তার আপন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির অনুসরণে এখানেই স্বর্গ বা নরক সৃষ্টি করে। আবার এখানেই আমরা মানুষের মধ্যে দেখতে পাহ দেবভাবাপন্ন মানুষ ও আসুরিক মানুষ। অবহ্য মনুষ্যনামধারী প্রাণীর উচিত সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মের দ্বারা দুঃখময় পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করা।

রচনা

১। মঙ্গল কক্ষপথে ভারত ।

নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মরু অভিযানে,

বক্ষ বাঁধিয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে! )

তবুও থামে না যৌবন-বেগ, জীবনের উল্লাসে

চলেছে চন্দ্রে-মঙ্গল গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।

— নজরুল ইসলাম

ভূমিকা – ভারতের মহাকাশযান! মঙ্গলের কক্ষপথ! ‘ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’! মঙ্গলের মহাকাশ! ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ভারতীয় সময় কাল ৭টা থেকে ৮-টার মধ্যে মিনিটে বিরলতম বিজ্ঞান-ইতিহাসে ঢুকে পড়া! এর আগে কোনোও দেশই প্রথম অভিযানেই সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে মহাকাশযান স্থাপন করতে পারেনি! বেশ কয়েকবার ব্যর্থতার পরে মঙ্গ ল অভিযানে সাফল্য পেয়েছে মাত্র কয়েকটি দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাআমেরিকা, রাশিয়া এবং ইউরোপ স্পেস এজেন্সি। ছিল ভারতের সামনে ওই এলিট ক্লাবের চতুর্থ সদস্য হওয়ার হাতছানি। দেশের বিজ্ঞানসচেতন মানুষ গভীর আগ্রহের সঙ্গে সন্ধিক্ষণের অপেক্ষায়। শেষপর্যন্ত ভারত সৃষ্টি করল নতুন ইতিহাস। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, সকাল ৭টা ৫৮টা মিনিটে ভারতের মঙ্গলযান সফলভাবে লালগ্রহের কক্ষপথে ঢুকে পড়ল।

শুভারম্ভ – কীভাবে চালানো হয়েছে এই দুরূহ অভিযান? ৫ নভেম্বর, ২০১৩। দুপুর। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্রের লঞ্চিং প্যাড থেকে ‘মার্স অরবিট মিশন’ নামের মঙ্গলযানকে সঙ্গে নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দেয় ‘পিএসএলভি’ নামের রকেট। এই বাহকের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানীদের আগাম হিসেবমতো মঙ্গলযান নিজের গতিপথে যাত্রা জারি রাখে। সেদিন প্রশান্ত মহাসাগরে দাঁড় করিয়ে রাখা দুই অসামরিক জাহাজ ‘নালন্দা’ আর ‘যমুনা’ রকেটের সংকেত ধরতে সফল হয়েছিল। একই সঙ্গে সৌর প্যানেলগুলিও সাফল্যের সঙ্গে কাজ শুরু করে। গতিপথ বজায় রেখে উৎক্ষেপণের ঠিক ৪৪ মিনিটের মাথায় পৃথিবীর উপবৃত্তাকার পথে পৌঁছে যায় মঙ্গলযান। এই অবস্থানে যানটির পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের দূরত্ব ছিল ২৫০ কিলোমিটার এবং সবচেয়ে দূরের দূরত্ব ছিল ২৩,৫০০ কিলোমিটার। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, এই দূরত্ব অতিক্রম করতেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল চিনের ‘ইয়ন্‌ঘো’ (২০১১) আর জাপানের ‘নোজোমি’ (১৯৯৮) মহাকাশযান। ভারতের মহাকাশযান অবশ্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পরের ২৪ দিন ওই কক্ষপথে সফলভাবে ঘুরপাক খেয়েছিল।

সময়ের দাম – বিজ্ঞানীরা জানতেন, কম খরচে মঙ্গলে যান পাঠাতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর সেই সময়টি খুঁজে পেতে অঙ্ক করে দেখতে হয়, কখন বা কোনো দিন মঙ্গল, পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে আপেক্ষিক অবস্থানের কৌণিক মান ৪৪ ডিগ্রি হবে। এই সময়টা সাধারণত ৭৮০ দিন বা আড়াই বছর পর পর আসে। আমাদের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০২১ -র স্বাধীনতা দিবসে ভারতে মঙ্গলযান পাঠানোর কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করেছিলেন। তখন মঙ্গলগ্রহের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসার দিনগুলো (কৌণিক মান ৪৪ ডিগ্রি) ছিল ২০১৩-র নভেম্বর, ২০১৬-র জানুয়ারি এবং ২০১৮ -র মে মাস। অতএব, আইএসআরও-র বিজ্ঞানীরা চার বছর অপেক্ষা না করে মাত্র পরেনো মাসেই মঙ্গলযানকে মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনাকে রূপায়িত করেন।

শুদ্ধকরণ – এই মহাকাশযান ৪৪০ নিউটন শক্তিসম্পন্ন ‘লিক্যুইড অ্যাপোজি মোটর’ বা ‘ল্যাম’-এর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গতিপথ বদল করতে পারে। একেই বলা হয় গতিপথের শুদ্ধকরণ। এই ধরনের শুদ্ধকরণ প্রথম ঘটানো হয় ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণের (নির্ধারিত তারিখ ছিল ৯ এপ্রিল, ২০১৪) প্রয়োজন হয়নি। তৃতীয়টি ঘটানো হয় ১১ জুন, ২০১৪। চতুর্থটি অগাস্টে। আর শেষবারের মতো বিস্ফোরণের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। এই বিস্ফোরণের লক্ষ্য মঙ্গলযানের গতি সেকেণ্ডে ১.১ কিমি করে কমানো। এর ফলে যানটি মঙ্গ লগ্রহের অভিকর্ষের টানে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরতে থাকবে।

ভারতের কৃতিত্ব – এই নয়া ইতিহাসকে নতুন মাত্রা দিয়েছে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য। অভিযানের সাফল্যকে তুলনা করেছেন মা-ছেলের মিলন হিসেবে। বলেছেন, “মম (মঙ্গলযান ওরফে মার্স অরবিটার মিশন, সংক্ষেপে মম) কো মঙ্গল মিল গয়ি। মঙ্গল কো মম মিল গয়া।” ইসরোর এই সাফল্য মাপতে গিয়ে তিনি টেনে এসেছেন ক্রিকেটের প্রসঙ্গও। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “বিদেশে গিয়ে কাপ জিতলে দেশবাসী আনন্দ করেন। এই সাফল্য হাজারটা কাপ জেতার সমান।”

শুধু নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা তৈরিই নয়, দেশের সামনে মহাকাশ বাণিজ্যের দিগন্ত খুলে দেওয়ার কাজটাও এই মঙ্গল অভিযান সেরে ফেলল বলে বিজ্ঞানীদের অনেকের মত। তার একটা বড়ো কারণ অনেক কম খরচে সাফল্য ছুঁয়ে ফেলা। যে সাফল্যকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে নিজের লেখা দু’লাইনের একটা কবিতা শুনিয়েছেন মোদী। “ব্যর্থ হলে হতে হয় সমালোচনার পাত্র। আর সাফল্যে ঈর্ষার পাত্র।” সত্যিই তো! জাপান বা চিন যা পারেনি, বহু গুণ অর্থ খরচ করেও আমেরিকা একবারে যা করে দেখাতে পারেনি, ভারত এক দানে মাত করেছে সেই কিস্তি ঈর্ষা তো হবেই!

দশমাস ধরে ছুটেও এতটুকু ক্লান্ত হয়নি সে! বরং পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে মঙ্গলযান। বুধবার (24.09.14) সকালেই লাল গ্রহের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে ভারতের মঙ্গলযান। প্রথম বারের চেষ্টাতেই সফল হয়েছেন এ দেশের বিজ্ঞানীরা। তৈরি হয়েছে নতুন এক ইতিহাস। এ বার উপবৃত্তকার কক্ষপথে মঙ্গলকে কেন্দ্র করে পাক খাবে সে। এক বার কাছে আসবে, আর এক বার গ্রহের দূরে যাবে। সবচেয়ে কাছে যখন আসবে, মঙ্গল থেকে তার দূরত্ব হবে ৪২৩ কিলোমিটার। আর দূরত্ব যখন সবচেয়ে বেশি, ব্যবধান ৮০,০০০ কিলোমিটার। মঙ্গলকে একবার পরিক্রম করতে ভারতীয় যানের সময় লাগবে ৭৬,৭২ ঘণ্টা (৩.২ দিন)। আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই তার শরীরে বসানো পাঁচটি যন্ত্রের (মার্স কালার ক্যামেরা, লাইম্যান আলফা ফটোমিটার, মার্স মিথেন সেন্সর, মার্স এক্সোস্ফোরিক নিউট্রাল কম্পোজিট অ্যানালাইজার, থার্মাল ইনফ্রারেড ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার) সাহায্যে মঙ্গলের মাটির গঠন, চরিত্র, আবহাওয়ার প্রকৃতি, বাতাসে মিথেন গ্যাসের চিহ্ন রয়েছে কি না এবং বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে অ-তড়িতাহত কণার সম্পর্কে গবেষণা করবে মঙ্গলযান।

অভিযানের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব – ইসরো সূত্রের খবর, মঙ্গল গবেষণায় বিশ্বের গবেষকদের চোখ এখন একটাই দিকে। তা হল মঙ্গলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না? মঙ্গলযানে সেই মিথেন গ্যাসের সন্ধানকারী যন্ত্রও বসিয়ে রেখেছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের একাংশের বক্তব্য মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব মিললে বোঝা যাবে, এক সময়ে মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। সে ক্ষেত্রে মহাকাশ গবেষণায় ফের নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি করবে ইসরো। কিন্তু মঙ্গ লযানের পক্ষে মিথেন গ্যাস খুঁজে বের করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই বলছেন কিউরিওসিটিকেও মিথেন সন্ধানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে পারেনি। মাটিতে নেমে রোভার যা পারেনি, কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে মঙ্গলযানের পক্ষে এই কাজ কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিজ্ঞানীর মধ্যে। একই সুর নাসার মঙ্গল অভিযানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষেরও। তবে তিনি মনে করেন, মঙ্গলযান পারবে না, এটা এখনই নিশিন্ত করে বলা যায় না।

মঙ্গল নিয়ে অবশ্য সেই ১৯৬৯ সাল থেকেই গবেষণা চলছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, রাশিয়া, ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার অনেকগুলি কৃত্রিম উপগ্রহ (রবাইটার) এবং মঙ্গলগাড়ি (রোভার) লাল গ্রহের মাটিতে কাজ করছে। ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪,-তে মঙ্গলে পৌঁছেছে নাসার নতুন কৃত্রিম ‘ম্যাভেন’। তথ্য পাঠাতে শুরু করেছে সে-ও। এত কিছুর পরেও মিথেন ছাড়া আর কী নতুন তথ্য দেবে ভারতের এই ‘দূত’?

উপসংহার – বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গল নিয়ে বহু গবেষণাই এখনও অসমাপ্ত রয়েছে। তা না হলে মঙ্গলযানের সময়েই নাসা ফের নতুন করে ‘মাভেন’ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে সেখানে পাঠাত না। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গলযানের তথ্য ভারতের নিজস্ব হবে। উপকৃত হবেন দেশের গবেষকেরাই। বেঙ্গালুরুর ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বিজ্ঞানী-শিক্ষক সুজন সেনগুপ্ত বলেছেন, মঙ্গলযানে বসানো মার্স. ক্যামেরা এবং থার্মাল ইনফ্রারেড ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার মঙ্গলের মাটি নিয়ে নতুন তথ্য দিতেই পারে। বিশেষ করে মঙ্গলের মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন কী, সেখানে সাম্প্রতিক কোনোও সময়ে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে কী না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য মিলে অভিযানের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যাবে। ইতিহাস, সন্ধিক্ষণ এবং এক মহাজাগতিক যাত্রা! জগৎসভা থেকে উৎক্ষিপ্ত মঙ্গলসভার নতুন অতিথি ভারত। মঙ্গল হোক!

২। গ্রিনহাউস এফেক্ট ও বিশ্ব উষ্ণায়ণ

“প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছু দূর পর্যন্ত সয়, তারপরে বিনাশের পালা। ……..যথোচিত সীমার বিরুদ্ধে নিরতিশয় ঔদ্ধ্যতকে বিশ্ববিধান কখনই ক্ষমা করে না। প্রায় সকল সভ্যতায় অবশেষে এসে পড়ে এই ঔদ্ধত্য এবং নিয়ে আসে বিনাস।”—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভূমিকা – সেই কবে ১৮২৪ সালে ফরাসী গণিতজ্ঞ যোসেফ ফুরিয়রই খুব সম্ভবত পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রথম হিসাব দিয়েছিলেন। তিনি বুঝিয়েছিলেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকে পড়া সৌর বিকিরণ (Solar radiation) পৃথিবীর পৃষ্ঠের দিকে ফিরে আসছে আর পৃথিবীর তাপ বাড়ছে। ফুরিয়রের এই পর্যবেক্ষণলব্ধ তত্ত্বকে নোবেলজয়ী স্যাভান্তে অ্যারহেনিয়াস নাম দিয়েছিলেন ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’, যার মূল বক্তব্য হল আমাদের এই সবুজ পৃথিবীর ওপর সৃষ্ট একটা কোনও প্রভাব পৃথিবীর তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৫০-এর দশকে জি- এস- ক্যাল্লেনডার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপর নাটকীয় প্রভাবকে প্রমাণ করলেন। এরপর বিভিন্ন গাণিতিক মডেল থেকে প্রমাণ হতে থাকে, মানুষের অবিমৃশ্যকারী ক্রিয়াকর্মই পরিবেশের ওপর এই প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বকে উষ্ণায়ণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের বিচারহীন ভোগ ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂), মিথেন (CH₄), ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) এবং নাইট্রাস অক্সাইডের (N₂O) মতো জ্বলনশীল যৌগ পদার্থগুলি হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে আমাদের এই সবুজ পৃথিবীর বুকে এবং এই দাঁহিকা শক্তিগুলির (যার নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিন হাউস গ্যাস) প্রভাবে পরপরই বেড়ে চলেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা।

তাপমাত্রা ও আমরা – আশির দশক থেকে এইসব বিভিন্ন দাহিকা যৌগগুলির প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে ৬২০জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত আই পি সি সি-র (জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তঃসরকারি প্যানেল) বিশেষ কমিটি দেখিয়েছে, গত শতাব্দীতেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশ্বের এই গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি আমাদের উন্নয়নকে প্রতিহত করছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল খাদ্য, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা, শিশুমৃত্যু, জল, স্বাস্থ্য ও অনাময়ের মতো আটটি বিষয় নিয়ে পৃথিবীর ১৮৯টি দেশের সঙ্গে আমরাও রাষ্ট্রসংঘের কাছে ‘সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য’ (MDGs) পূরণে যে ব্রত গ্রহণ করেছিলাম, এখনও সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। এদিকে ২০১৫ সালই এই লক্ষ্য পূরণের শেষতম বছর। অথচ বিকারগ্রস্ত জলবায়ু আমাদের দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত ভারত গঠনে উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃষি – এ বিষয়ে প্রথমে দেখা যাক কৃষির বিষয়টি। রাষ্ট্রসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংগঠন’ এর (FAO) হিসাব অনুযায়ী, ভারতের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষই বৃষ্টিনির্ভর কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ফলে সুস্থ ও স্বাভাবিক মৌসুমি বায়ু তথা জলবায়ু তাঁদের কাম্য। কিন্তু বর্তমান বিকারগ্রস্ত জলবায়ুর কারণে (২০০) সালে একদিকে প্রবল বন্যা ও অন্যদিকে নিদুরুণ খরার কারণে) কৃষির বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ০.২ শতাংশ হারে, গত বছরও যা ছিল ১.৬ শতাংশে। অথচ স্বাভাবিকভাবে এই বৃদ্ধির হার হওয়া উচিৎ অন্তত ৪ শতাংশ হারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে লেম্যান ভ্রাতৃদ্বয়ের তৈরি একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদন যে পরিমাণে কমবে তাতে ভারতের জি ডি পি ৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে। এর ফলে কী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জল – এখন আমরা গড়ে মাথাপিছু জল সংরক্ষণ করতে পারি ২১৩ কিউবিক মিটার। তুলনামূলকভাবে এই মাত্রা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও চিনের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৪,৭৩৩, ১.৯৬৪ ও ১,১১১ কিউবিক মিটার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই যে সামান্য পরিমাণ জল আমরা সংরক্ষণ করি, তার সবটুকুই নির্ভর করে আগষ্ট-সেপ্টেম্বরের মোটামুটি ৫০ দিনের বৃষ্টির ওপর। অথচ এই বৃষ্টিটাই এখন অনিয়মিত। ভারতে এই অনিয়মিত বৃষ্টির কারণ হিসেবে প্রফেসর ভি, রামনাথন ‘এশিয়ান ব্রাউন ক্লাউডের’ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ভারতের বায়ুস্তরের ৫-১০ শতাংশ এখন সালফেট্স ও নাইট্রেটসে তৈরি ‘বাদামি মেঘে’ ঢাকা। এই বাদামি মেঘ এবং ব্ল্যাক কার্বন আমাদের হিমবাহুগুলিও ঢেকে ফেলেছে, ফলে সেখানেও গলন শুরু হয়ে গেছে। গলনের ফলে ভারতবর্ষের নদীগুলি প্লাবিত হতে হতে নদীগুলির গতিই একসময়ে রুদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি শুধু প্লাবিতই হবে না, সেখানকার মিষ্টি জলের আধারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্বাস্থ্য – জলবায়ুর পরিবর্তন স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেও, প্রভাবিত করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার’ (WHO) মতে, গড়ে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির অর্থ—বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু। ভারতবর্ষ উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

জলবাহিত জীবাণুবাহিত, তাপবাহিত রোগের সঙ্গে তাপের পরিবর্তন ভারতে মানসিক চাপজনিত রোগেরও বৃদ্ধি ঘটাবে। কারণ তাপের পরিবর্তন মানুষের স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেলে মানুষের মধ্যে একটা ব্যবহারগত পরিবর্তন আসবে। শুধু তাই নয়, মানুষের জীবন-প্রকৃতিতেও একটা পরিবর্তন ঘটাবে। অন্যদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি মশার প্রাণশক্তি বাড়িয়ে দিয়ে ম্যালেরিয়া জাতীয় অসুখেরও প্রাদুর্ভাব ঘটাবে।

দারিদ্র্য – জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তার ফলে মানুষের আশ্রয়হীনতা ও কর্মহীনতা ও খাদ্যশষ্যে ঘাটতি। সেইসব অসুখবিসুখ ও চিকিৎসার খরচ বাড়তে থাকা আর এসবের মিলিত ফল দারিদ্র্য।

ক্ষুধা ও অপুষ্টি – এই শতাব্দীর মাঝামাঝি শুধুমাত্র বিকৃত জলবায়ুর কারণে আরও ২৫ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত শিশু আমাদের এই বিশ্বে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে (IFPRI)।

উপসংহার – আসলে আমরা বাঁচব এবং বাঁচতে দেব কি না, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে একটা দর্শনের ওপর। পরিবেশ ও উন্নয়নের সম্পর্ক সম্পূর্ণ নির্ভর করে জীবনের গুণগত মান সম্পর্কে সমাজের ধারণার ওপর। সুতরাং উষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন আর বাড়তে না দিতেহলে ব্যক্তিগত স্তরে মানসিকতার তথা সমাজের ধারণার পরিবর্তন ঘটানো খুবই দরকার। ধারণার এই পরিবর্তন ঘটলে আমাদের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিশ্চয় আমরা কার্বনের নিঃসরণ অনেকখানি কমিয়ে পরিবেশকে কলুষমুক্ত রাখতে পারব। সুতরাং এইভাবে যদি আমরা ব্যক্তিগত স্তরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগের মাত্রা কমিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন বিকল্প পথ ও এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি, তবে আমরা আমাদের প্রকৃতিকে আবার আগের মতো স্বাভাবিক ছন্দে পুরোপুরি আনতে না পারলেও পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারব। লক্ষাধিক বছর আগেও যদি পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা ৭-১০ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, ঋগ্‌গ্বেদের যুগের আট ঋতু থেকে যদি আমরা ক্রমে ছয় ঋতুতে বেঁচে থাকতে পারি, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা তো করতেই হবে।

৩। বাংলার সংস্কৃতি

ভূমিকা – সভ্যতা ও সংস্কৃতি—মানবজীবনের এই দুটি দিক পরস্পরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে বিশ্লেষণ করা কঠিন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবজীবনে সংস্কৃতিরও উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষ নিজেকে যত নতুনভাবে সংস্কার করেছে তার সংস্কৃতি তত সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। একটি সংজ্ঞার মধ্যে সংস্কৃতি বিষয়টাকে ধরা যায় না। সংস্কৃতি—জীবনাচণের একটি অঙ্গ সংস্কৃতি জাতির মধ্যে কতকগুলি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। তার চলাফেরা, আচার-আচরণ, তার শিল্পসাহিত্য- সংগীত, তার মার্জিত ও উন্নত মানসিকতা— এসিব মিলিয়ে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি— জীবনের গৌরবময় প্রকাশ। সংস্কৃতির ভাবরসেই জাতির সামগ্রিক বিকাশ। সব বিষয়ে উন্নতির পরিণাম হল সংস্কৃতি। সংস্কৃতি দিয়ে একটি জাতিকে চেনা যায়।

বাঙালির উদ্ভব, তার ভাষা ও সংস্কৃতি – ভারতীয় সভ্যতা সূত্রপাত ঘটেছে আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। ভারতবর্ষের বিপুল ভৌগলিক পরিসরের মধ্যে ধীরে-ধীরেই তার বিস্তৃতি ঘটেছে। বহু জাতি ও উপজাতির সংমিশ্রণে ভারতীয় জনজীবন গড়ে উঠেছে। মুখের ভাষা ভেঙে-ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন ভাষা। বাংলাভাষা তার অন্যতম। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে এক বিশাল ভৌগলিক অঞ্চল জুড়ে বাংলা ভাষাগোষ্ঠী মানুষের বাস। বাংলা যাদের মাতৃভাষা, তারা সকলেই বাঙালি। ভাষা সঙ্গে সংস্কৃতির এক অচ্ছেদ্য বন্ধন রয়েছে। ভাষার মাধ্যমেই সংস্কৃতির একটি স্থায়ী রূপকে অনুভব করা যায়। বাঙালি জাতি বয়স হাজার বছরের। হিন্দু-মুসলমান-বৈৗদ্ধ-খ্রিস্টান—সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। আর্য-অনার্যের মেলবন্ধন ঘটেছে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গনে। বাঙালি এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যদিকে বাঙলাদেশ। এছাড়াও ভারতের অন্যত্র এবং সা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে বাঙালি। সবাইকে নিয়েই সম্মিলিত বাঙালি সংস্কৃতি।

বাঙালির সংস্কৃতির স্বরূপ – কোন জাতির সংস্কৃতির মৌলরূপকে বুঝতে গেলে তার ইতিহাসকে জানা আবশ্যক। সমগ্র মধ্যযুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির মূলে ছিল ভারতের গ্রামীণ জীবন। কৃষিকাজ ছিল গ্রামীণ মানুষের প্রধান জীবিকা। গ্রামীণ মানুষের বাস্তব জীবনের আশা-আকাঙ্খা, আনন্দ-বেদনা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানকে নিয়ে গড়ে উঠল তার সংস্কৃতি। তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল ধর্মাচরণ। বাঙালির প্রথম যুগে আর্যদের পৌরাণিক ভাবধারার সঙ্গে অনার্যদের লৌকিক ভাবধারার মিলন ঘটেছিল। এ ছাড়া ছিল বৌদ্ধদের প্রভাব। ত্রয়োদশ শতকে ঘটল মুসলমান ধর্মের অনুপ্রবেশ। গোটা মধ্যযুগ ধরে অসংখ্য বাঙালি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে সংস্কৃতির একটি নতুন ধারা যুক্ত হল। অষ্টাদশ শতকে এল ইংরেজ। ইংরেজি ভাষা হল আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম।

বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্বতা – বাঙালির জীবনাচরণের মধ্যে গ্রহণ, বর্জন ও সমন্বয়ের এক অসাধারণ মানসিকতা দেখা যায়। এই মানসিকতা ভারতীয় জীবনে বাঙালির মতো আর কোনো জাতির মধ্যে ঘটেটি। এই মানসিকতার মধ্য দিয়েই বাঙালির গ্রহণ ক্ষমতা বেড়েছে। মধ্যযুগে তাই সে অনায়াসে ফারসি ভাষা ও তার সংস্কৃতির গ্রহণ করতে পেরেছে। ইংরেজের কাছ থেকে সহজেই নিতে পেরেছে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে। সব সংস্কৃতিকেই সে নিজের মতো করে আত্মস্থ করে নিয়েছে। বাঙালির জীবন ও সাহিত্যে তার বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে। বাঙালিন্দ সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে আত্মীকরণের দুর্লভ প্রাণশক্তি। মধ্যযুগের কূপমণ্ডূক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাঙালি কখনও মৌলবাদের পথ অনুসরণ করেনি।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি – মধ্যযুগে বঙ্গসাহিত্যের সার্থক প্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে, বৈষ্ণবপদাবলিতে, আরাকান রাজসভার কবিদের রচনায় ও আগমনিবিজয়া গানে। এ ছাড়া ছিল রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি পৌরাণিক সাহিত্যের অনুবাদ। মহুয়া-মালুয়ার প্রেম সংগীত, শিব-পার্বতীর গার্হস্থ্য চিত্র, মেনকার সন্তান-বাৎসল্য এবং চাঁদসদাগরের অনমনীয় পৌরুষে বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। বাঙালি কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি। ইউরোপের সান্নিধ্যে এসে তার জীবনে এল নবজাগরণের সুপ্রভাত। বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল। বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ— বাঙালি জাতির সংস্কৃতিকে বিশ্বসংস্কৃতির সমতুল্য করে তুললেন।

উপসংহার – বাঙালির জীবনে বারবার এসেছে সংকট। স্বাধীনতার সঙ্গে-সঙ্গেস বাংলাদেশ হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। বাঙালির জীবনবোধের মূলে বারবার আঘাত করেছে সাম্প্রদায়িকতা। বাঙালির বিদ্রোহী সত্তা কখনোই নেতিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, উদার মানবতাবাদ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় আজও সে ভারতের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে।

৪। আসামের উৎসব-সংস্কৃতি-লোকধর্ম।

প্রাচীনকাল থেকেই আসামের রহস্য ও মোহময় আকর্ষণে দলে দলে মানুষ এসেছে এখানে। সকলকেই আসাম সাদরে গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির সংমিশ্রণে এখানকার সংস্কৃতি ও লোকধর্ম গঠিত হয়েছে।

পৌরাণিক যুগে প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপের খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত ছিল। যদিও প্রাচীনকালে এখানে আর্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে তবু তা সেখানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। নাগা, কুকী, মিশটি, আরব, মিকির প্রভৃতি নানা জাতির অবদানে আসামের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

বাংলার মতো নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আসাম তার লোকধর্ম অভিব্যক্ত করেছে। দুর্গোৎসব, বিহু উৎসব, শৈব-গীত, রামায়ণী গান, রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসমবাসী তাদের ঈশ্বরের অন্তরোপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছে। এই অনুষ্ঠানগুলিই এখানে লোকউৎসবের রূপ ধারণ করেছে। আসামের সকল শ্রেণির মানুষ এইসব উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। আসামের লোকধর্ম এখানকার মানুষের অন্তরের মুক্ত অভিব্যক্তি বলা যায়।

এখানকার লোকধর্মের প্রধান কেন্দ্র হল কামরূপ কামাখ্যাদেবীর মন্দির। এটি একটি মহাতীর্থ। এই মহাতীর্থকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তী। রাজা নরনারায়ণ কামাখ্যাদেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরে প্রতিষ্ঠাতা দেবী কামাখ্যা। কামাখ্যা শক্তিসাধনার একটি প্রধান কেন্দ্র। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে দেবীর উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করেন। আহোম রাজাদের সময়ে এখানে দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবদেবীর পূজার প্রচলন। শ্রীকৃষ্ণের লীলা উৎসবও এখানে অনুষ্ঠিত হয়।

এখানকার সর্বপ্রধান লোকভিত্তিক উৎসব হল বিহু উৎসব। বহাগ, কাতি ও মাঘ এই তিনটি বিহু তিনটি বিশেষ ঋতুতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ঋতু উৎসব হলেও এগুলি ধর্মানুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বহাগ বা বৈশাখী বিহু বসন্ত ও নববর্ষের উৎসব। এতে আসামের মানুষ কোন উন্মুক্ত স্থানে, বাঁশবনের ছায়ায় বা আম্রকুঞ্জে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। নাচ ও গান করে, গানগুলি হল বিহুগীত। বিষয় প্রকৃতি ও প্রেম। দুইমাস—চৈত্র ও বৈশাখে চলে এই উৎসব। আশ্বিনের শেষ দিন থেকে শুরু হয় কাতি বিহু বা কাঙালী বিহু। এই সময় তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়া হয় এবং আকাশপ্রদীপ জ্বালা হয়। তিনটি বিহুর মধ্যে মাঘ বা ভোগালী বিহু সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব। ঘরে ঘরে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য। সকলে মিলে মিশে ভাল ভাল খাদ্যদ্রব্য খায়। এই উৎসব আসামবাসীর প্রাণের উৎসব।

লোকধর্মের সঙ্গে আসামে লোকউৎসব মিশে রয়েছে। এখানে এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ আর তাতে সকলে মিলে প্রতিটি মুহূর্তকে যেন উৎসব মুখর করে তোলে। নৃত্যগীত চলে প্রতিদিনই। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এখানে সকলে লোকউৎসবের সামিল হয়। তাই আসাম যেন জাতীয় সংহতির পীঠস্থান।

অসংখ্য জাতির মিলনক্ষেত্র এই আসাম। নানা স্থান থেকে নানা মানুষের ধারা এখানে মিলিত হয়েছে। তাই নানা উৎসবের মধ্যে এসেছে বৈচিত্র্য। জাতীয় সংহতির পক্ষে নানা উৎসবের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। আসামের লোকউৎসবসমূহের মধ্যে তার প্রাণসম্পদ লুকানো রয়েছে। তাই রাজনীতির অনুপ্রবেশে যাতে আসামের লোকধর্ম বিঘ্নিত না হয় সেদিক লক্ষ্য রাখা বিশেষ প্রয়োজন।

৫। আসামের রেশম শিল্প।

আসামের রেশমশিল্প বিশ্ববিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকেই তার নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে মুগা রেশমবস্ত্র পাওয়া যায়। গুটিপোকা পালন ও রেশমবস্ত্র উৎপাদনে চীনদেশের মতো কামরূপের খ্যাতি ছিল। বোড়ো সম্প্রদায় প্রথম গুটিপোকার চাষ শুরু করে।

সারা ভারতে যত রেশম উৎপাদিত হয় তার বেশির ভাগ হয় আসামে। চাষবাসের ঋতুর আগে ও পরে অবসর সময়ে কৃষক সম্প্রদায় রেশম উৎপাদন করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই কাজে নিযুক্ত থাকে।

রেশম উৎপাদনের প্রথমে চাই রেশমকীট পালন। ওরা গুটি তৈরি করে। গুটি হতে আঁশ পাওয়া যায়। এই আঁশ তিন রকমের—এড়ি, পাট ও মুগা। প্রধানত তিনশ্রেণির রেশমকীট দেখা যায় (১) এড়ি (২) মুগা (৩) পাট। এড়ি পোকারা রেড়ি গাছের পাতা খায়। মুগা রেশমের উপরিভাগ।

তিন রকম রেশম থেকেই রেশম বস্ত্র উৎপাদিত হয়। বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে এই পোষাক ব্যবহৃত হয়। এখানকার নারীসমাজ রেশমবস্ত্র উৎপাদনে অগ্রণী। তারা গুটি পোকা পালনের কাজও করে। সমবায় সমিতির মাধ্যমে গুটি পোকার চাষ হয়। রেশম কীটের শ্রেণিবিভাগ মত রেশম বা সিল্কের শ্রেণিবিভাগ হয়। এড়ি পোকারা যে রেশম তৈরি করে তা থেকে এণ্ডিবস্ত্র তৈরি হয়। শীতের সময় এর খুব চাহিদা। মুগাবস্ত্র হয় সোনালী হলুদ রঙের। পাট রেশমের আঁশ সব চাইতে মোলায়েম ও মসৃণ। এর রং সাদা আর হলুদের মাঝামাঝি। আসামের নানা অঞ্চলে ব্যাপক রেশমবস্ত্র উৎপাদিত হয়। দরং জেলায় এড়িও পাট রেশমবস্ত্র বেশি উৎপন্ন হয়, মুগা হয় কম। গোয়ালপাড়া অঞ্চলে এড়ি সবচেয়ে বেশি হয়, মুগা ও পাট রেশমবস্ত্র উৎপন্ন হয় কম। গারো পার্বত্য অঞ্চলে এড়ি চাষ প্রধান। নওগাঁ ও কামরূপে তিন রকম রেশম উৎপন্ন হয়। শিবসাগর জেলায় মুগা হয় খুব বেশি। এড়ি সুতো দিয়া তৈরি হয় বোরকাপড়, এড়িপশরা ও চাদর। পুরুষরা এইগুলি ধুতি ও আংরাখা রূপে ব্যবহার করে। পাট ও মুগার সুতা দিয়া মেখলা, চাদর, রিহা, চেলেঙ, ব্লাউজ শাড়ি প্রভৃতি তৈরি হয়।

আসামের রেশম শিল্প এর গর্ব এবং গৌরব। এই শিল্পের উন্নতির জন্য সরকার পক্ষ হতে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখানকার রেশম শিল্প যাতে তার গৌরব ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারে সেজন্য সকলকে সতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে।

৬। অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব।

ভূমিকা – মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যেমন আহার-বস্ত্র-বাসস্থানের দরকার তেমনি প্রয়োজন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার। সেই ভারসাম্যে পশু, পাখি, অরণ্যভূমি সব কিছু সংযুক্ত। অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী দেশের অন্যতম সম্পদও। এগুলির যথাযথ রক্ষা করাও মানুষের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঘ, হরিণ, ময়ূর, গন্ডার প্রভৃতি প্রাণীকে রক্ষা করা এবং সেই সঙ্গে অরণ্যভূমিকে রক্ষা করাও সরকারি পরিকল্পনার অন্তর্গত হওয়ার ফলে এই সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা – ভারতের বন্যপ্রাণী অন্যান্য দেশের তুলনায় রকমারি বৈচিত্র্যমণ্ডিত। বন্যপ্রাণী সম্পদের মধ্যে ছোট কানওলা হাতি, একশৃঙ্গী গণ্ডার, বাঘ, ময়ূর, সিংহ, বুনো শুয়োর, ভাল্লুক ও নানা ধরনের বর্ণময় পাখি, কুমির, ঘড়িয়াল, নানা শ্রেণির বানর, হনুমান, হরিণ প্রভৃতি বন্যসম্পদের প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এত বৈচিত্র্য একসঙ্গে অন্য কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ। এই বন্যসম্পদের প্রজাতিকে লুপ্ত হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যেই অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজন।

সমস্যার কারণ – অন্যান্য দেশে যেমন শিল্পের উৎকর্ষ সাধনে অরণ্যপ্রাণী হত্যা করা হয়, এদেশে অরণ্যপ্রাণী ক্রমলুপ্তি সেই পথ ধরে হয় না। এদেশের অরণ্যসম্পদ সংকীর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হল জনবিস্ফোরণ ও অনুপ্রবেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে অরণ্যসম্পদের ব্যস্তানুপাতিক ক্রমহ্রাসমানতা লক্ষ্য করা যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ভূ-ভাগের মাত্র ১৩.৫ শতাংশ জুড়ে অবস্থান করছে বনভূমি। যেখানে এই পরিমাণ ভূ-ভাগের ৩৩ শতাংশ থাকা সমীচীন। প্রথমত, বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অরণ্য অঞ্চল সঙ্কুচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অরণ্যের কাছাকাছি বসবাসকারীদের গৃহপালিত পশুদের আহারের জন্যে মানুষ অরণ্যের ডালপালাকে কাজে লাগিয়েছে। তৃতীয় কারণের মধ্যে পড়ে সরকারি বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ। যেমন তুঙ্গভদ্রার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে ব্যাপক হারে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা আরম্ভ হয়। এছাড়াও সখের খেয়ালে বন্যপ্রাণী হত্যা, মাংসের লোভে, চামড়ার লোভে, নানা শ্রেণির প্রাণী হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। হিসেবানুযায়ী সবুজ উদ্ভিদ ৯৯ শতাংশ থাকলে সেখানে ১ শতাংশ প্রাণী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সবুজ নিধনের ফলে অরণ্যের পরিধি কমেছে বহুলাংশে। সুন্দরবন, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলার কিছু অঞ্চল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে স্বাভাবিক অরণ্য প্রায় নেই বললেই চলে। সবুজের অভাবে অরণ্যপ্রাণীদের সঙ্গে জলবায়ুরও ভারসাম্য রক্ষার সমস্যা দেখা দিয়েছে।

সংরক্ষণের আবশ্যিকতা – অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজন পরিবেশ রক্ষা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুরক্ষিত করার কারণে। মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করতে হবে সবুজের, রক্ষা করতে হবে প্রাণীসম্পদকে। অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সর্বপ্রথম কাজ হল জনবিস্ফোরণ ও অনুপ্রবেশ সংহত করা। অরণ্যপ্রাণীদের সঙ্গে সুষম আচরণ অর্থাৎ তাদের ওপর অনাবশ্যক অত্যাচার বন্ধ করা অবশ্য কর্তব্য। তাদের বিকাশ ও বিবর্তনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করা।

উপসংহার – জলবায়ুসহ প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আবশ্যিক। এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা শুধু সরকার নয় প্রতিটি মানুষকেই গ্রহণ করতে হবে। সবুজ সৃষ্টি, প্রাণী নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ সহ প্রাণীসম্পদের বিকাশের দিকটাও ভাবা কর্তব্য। সবুজ অরণ্যকে কোনো অজুহাতেই সংকীর্ণ করলে মানব জীবনচর্যার আগামী দিনে আরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাই জরুরী কর্তব্য ভিত্তিতে অরণ্য ও অরণ্যসম্পদ রক্ষা আমাদেরই করতে হবে। এ ব্যাপারে সকলেরই সহযোগীতা আশু প্রয়োজন।

৭। মহাপুরুষ শ্রীশঙ্করদেব।

সূচনা – ভারতের ধর্মীয় মহাপুরুষদের মধ্যে শ্রীশঙ্করদেব অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে আছেন। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আবির্ভাবের ফলে আসামের জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নবজাগরণের সূচনা হয়। তাঁর প্রভাবে আসামে ধর্মসাহিত্য ও সমাজ উদার মানবতাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে

সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথ খুঁজে পায়। 

বংশ পরিচয় ও বাল্যজীবন – শ্রীশঙ্করদেব আনুমানিক ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে আহোম রাজ্য নগাওঁর অন্তর্গত আলিপুখুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কুসুমবর ও মাতার নাম সত্যসন্ধা। জনশ্রুতি এই যে মহাদেবের বরে কুসুমবর এই পুত্ররত্ন লাভ করেন। শঙ্করদেবের জন্মমুহূর্তে এবং বাল্যজীবনে নানাপ্রকার অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। শৈশবেই তিনি পিতামাতাকে হারান এবং পিতামহী খেরসূচী কর্তৃক প্রতিপালিত হন। বালক শঙ্কর ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। তাই প্রথম দিকে বিদ্যাশিক্ষায় তাঁর তেমন মনোযোগ ছিল না। পরে বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বভাবের আমূল পরিবর্তন হয়। বিদ্যাচর্চায় তিনি গভীর অনুরাগ ও অসাধারণ মেধাশক্তির পরিচয় দেন। গুরু মহেন্দ্র কন্দলী তাঁর এই অসাধারণ শিষ্যটিকে ‘দেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকেই তিনি শ্রীশ্রীশঙ্করদেব নামে পরিচিত হন।

ধর্ম সাধনা ও সংসার-জীবন – শ্রীশঙ্করদেব তরুণ বয়স থেকেই শাস্ত্রগ্রন্থাদি পাঠ ও ধর্মালোচনায় ব্রতী ছিলেন। বিভিন্ন পন্থায় তিনি দীর্ঘকাল ধর্মসাধনা করেন। এইরূপ অধ্যয়ন ও সাধনার ফলে তিনি মানবজীবন ও ধর্ম সম্বন্ধে একটি উদার মতাদর্শে উপনীত হন। ধর্মসাধনা ও ধর্মপ্রচার শঙ্করদেবের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলেও সাংসারিক জীবনের কোনো কর্তব্যই তিনি উপেক্ষা করেন নি। তিনি বিবাহ করে সংসারী হয়েছেন, কিন্তু সংসারে আসক্ত হন নি। শঙ্করদেব মনে করতেন সংসারে বাস করে সাংসারিক প্রলোভন জয়ের চেষ্টা করতে হবে।

নূতন ধর্মমত প্রচার – শ্রীশঙ্করদেব প্রচারিত ধর্মের নাম ‘নব বৈষ্ণব ধর্ম’ বা ‘ভাগবত বৈষ্ণব ধর্ম’। ‘মহাপুরুষীয় ধর্ম’ ‘একশরণ ধর্ম’ নামেও পরিচিত। সর্বজীবে প্রেমভাব ও অহিংসা এই ধর্মের মূল আদর্শ। শ্রীচৈতন্যদেবের মতই শ্রীশঙ্করদেবের ধর্মেও অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের স্থান ছিল না। শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ঈশ্বর, তাঁর নামকীর্তন করলেই ঈশ্বরের কৃপা পাওয়া যায়—ভক্তের প্রতি এটাই ছিল শ্রীশঙ্করদেবের উপদেশ। সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ভাগবতী বৈষ্ণবধর্মের উদার আদর্শ। তৎকালে সমাজজীবনে নানাপ্রকার অন্যায় ও বৈষম্য প্রচলিত ছিল। তাই শঙ্করদেবের উদার ধর্মাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে নরনারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ধর্মপ্রচারে শ্রীশঙ্করদেবের প্রধান শিষ্য মাধবদেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বরদোয়া গ্রামে হরিমন্দির স্থাপন তাঁর অন্যতম কীর্তি। মাধবদেবকে সঙ্গে নিয়ে শঙ্করদেব কয়েকবার তীর্থভ্রমণে বের হন। বহু ধর্মগুরু ও সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজের ধর্মমতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।

শ্রীশঙ্করদেবের নাম – সমন্বয়মূলক ধর্মমত প্রচার করে তিনি আসামের সমাজ জীবনে যুগান্তর আনয়ন করেন। তাঁর মানবতাবাদের প্রভাবেই সমাজ হতে বহু কু-প্রথা ও অন্ধ সংস্কার দূর হয়। আসামের ভাষা ও ভাবাদর্শকে অনুসরণ করে অসমীয়া সাহিত্যের উদ্ভব হয়। তিনি পঁয়ত্রিশখানি গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। সেগুলির মধ্যে ‘কীর্তন’, ‘ বরগীত’ নামক দুটি ধর্মীয় গীতিসংকলন বিশেষ প্রসিদ্ধ।

উপসংহার – শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের একক প্রয়াসেই আসামের জনজীবন মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও সামাজিক কুসংস্কার হতে মুক্ত হয়েছে। তাঁর জীবন ও বাণীর আদর্শই পরবর্তীকালে আসামে ধর্ম সংস্কৃতি ও শিল্পসাহিত্যে নব অভ্যুদয় ঘটিয়েছে।

Leave a Reply

error: Content is protected !!
Scroll to Top