SEBA Class 10 Bengali Chapter – 6 সাগর-সঙ্গমে

Join Roy Library Telegram Groups

SEBA Class 10 Bengali Chapter – 6 সাগর-সঙ্গমে Question Answer As Per New Syllabus of SEBA Provided by The Roy Library is one of the best content available on the internet as well as many other offline books. SEBA Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Notes is made for SEBA Board Bengali Medium Students. SEBA Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Solutions We ensure that You can completely trust this content. SEBA Class 10 Bengali Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Suggestions If you learn PDF from then you can BUY PDF SEBA Class 10 Bengali textbook Solutions. I hope You Can learn Better Knowledge.

SEBA Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে

Today’s We have Shared in This Post SEBA Class 10 Bengali (MIL) Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Suggestions with you. SEBA Class 10 Bengali Solutions Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে I Hope, you Liked The information About The SEBA Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Notes. If you liked SEBA Class 10 Bengali Chapter 6 সাগর-সঙ্গমে Question Answer Then Please Do Share this Post With your Friends as Well.

সাগর-সঙ্গমে

অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ

◆ ক্রিয়াকলাপ :

প্রশ্ন ১। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও । 

( ক ) নবকুমার কে ? 

উত্তরঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ সাগরসঙ্গমে নবকুমার ’ গদ্যাংশের নায়ক চরিত্র হলো নবকুমার। 

( খ ) নবকুমার সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়ার প্রধান কারণ কী ছিল ?

উত্তরঃ দিকভ্রষ্ট নৌকার যাত্রীদের সকলের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণার্থে কাঠ যোগাড় করতে দেরী হওয়ায় এবং জোয়ার আসার ফলে নৌকা বহুদূরে ভেসে যাওয়ায় নবকুমার সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল । 

( গ ) নবকুমার নির্জন সমুদ্রতীরে বিজনে পরিত্যক্ত হল কেন ? 

উত্তরঃ গঙ্গাসাগর থেকে থেকে ফেরার সময় নবকুমার এক নদীর মোহনায় সকলের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণার্থে রন্ধনের উপযোগী কাঠ জোগাড় করতে গিয়েছিল ফিরতে দেরী হয় এবং জোয়ারের বেগে নৌকা বহুদূরে ভেসে যায় । নবকুমারের সঙ্গীরা এই পরিস্থিতিতে তার জন্য না ফিরে দেশের দিকে যাত্রা করে । নবকুমার সকলের ক্ষুৎপিপাসা কাঠ আনতে গেলেও তার সহযাত্রীরা এতবড় অকৃতজ্ঞ যে সেকথা ভুলে , সেই জনহীন অরণ্যে যানবাহনের সংশ্রবহীন সমুদ্রতীরে তাকে ফেলে চলে যায়।এটাই নবকুমার সঙ্গীগণ কর্তৃক বিজনে পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ । 

( ঘ ) ঘুম ভাঙার পর নবকুমার বহুদূরে কী দেখেছিল ? 

উত্তরঃ ঘুম ভাঙার পর নবকুমার বহুদূরে এক আলোকবিন্দু দেখতে পেয়েছিল । 

( ঙ ) কখন কাপালিকের সঙ্গে নবকুমারের সাক্ষাৎ হয়েছিল ? 

উত্তরঃ কাপালিকের ধ্যানভঙ্গের পরে নবকুমারের সঙ্গে কাপালিকের সাক্ষাৎ হয়েছিল । 

( চ ) ‘ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ? ‘ উক্তিটি কার ? 

উত্তরঃ উদ্ধৃত উক্তিটি কপালকুণ্ডলার । 

( ছ ) ‘ কস্তম ‘ শব্দটির অর্থ কি ? 

উত্তরঃ ‘ কস্তম ’ শব্দটির অর্থ হলো — ‘ কে তুমি ’ 

( জ ) নবকুমার জাতিতে কী ছিল ? 

উত্তরঃ নবকুমার জাতিতে ছিল ব্রাহ্মণ । 

( ঝ ) নবকুমার পর্ণকুটিরে কী খেয়ে ক্ষধা নিবারণ করেছিল ? 

উত্তরঃ নবকুমার পর্ণকুটিরে কাপালিকের দেওয়া ফল ও জল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছিল । 

( ঞ ) অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে কে নবকুমারকে পর্ণকুটিরের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ? 

উত্তরঃ অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে পর্ণকুটিরের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । 

( ট ) “ কাপালিক মনুষ্য , আমিও মনুষ্য ” উক্তিটি কার ? 

উত্তরঃ উক্তিটি নবকুমারের । 

( ঠ ) কাপালিকের পর্ণকুটিরে নবকুমার কী দেখেছিল ? 

উত্তরঃ কাপালিকের পর্ণকুটিরে পৌঁছে নবকুমার দেখেছিল কুটিরটি কিয়াপাতা দিয়ে তৈরি হয়েছে । তার মধ্যে কয়েকটি ব্যাঘ্রচর্ম , এক কলস জল ও কিছু ফলমূল রয়েছে । 

( ড ) কাপালিকের বয়স কত ছিল ? 

উত্তরঃ কাপালিকের বয়স ছিল প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। 

( ঢ ) প্রাতে উঠে নবকুমার কী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ? 

উত্তরঃ প্রাতে উঠে নবকুমার বাড়ি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । 

প্রশ্ন ২। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও : 

( ক ) ‘ সাগর সঙ্গমে নবকুমার ’ পাঠটি কার লিখিত কোন গ্রন্থের অন্তর্গত ? 

উত্তরঃ ‘ সাগর সঙ্গমে নবকুমার ’ পাঠটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত এবং ‘ কপালকুণ্ডলা ’ গ্রন্থের অন্তর্গত । 

( খ ) নবকুমার কোথায় , কীভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল ? 

উত্তরঃ সাগর – সঙ্গম থেকে ফেরার পথে নৌকার সহযাত্রীদের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্য বিজন বনে প্রবেশ করে কাঠ যোগাড় করতে সংগ্রহে দেরী হওয়ায় এবং সমুদ্রে জোয়ার আসার কারণে নির্জন বনে নবকুমার সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল । 

( গ ) কী রূপ পরিস্থিতিতে নবকুমার কী কারণে বিজন বনে পরিত্যক্ত হয়েছিল ? 

উত্তরঃ নবকুমার সমুদ্রতীরে বালিয়াড়ি ও অরণ্য সমাচ্ছন্ন একটি বিজন বনে নৌকারোহীদের দ্বারা বিসর্জিত হয়েছিল । কাঠ বহন করে নদীতীরে এসে সে নৌকা বা তার আরোহী কাউকে দেখতে পেলো না । প্রথমে ভাবলো , জোয়ারের বেগ কমলে নৌকা ফিরে আসতে পারে । কিন্তু নৌকা আর ফিরল না । রাত্রি হল । নবকুমার ক্ষুধা তৃষ্ণায় এবং ভয়ে কাতর হয়ে পড়ল ।

( ঘ ) কাপালিককে নবকুমার কোথায় কী অবস্থায় দেখতে পায় তা লেখো । 

উত্তরঃ সঙ্গীগণ কর্তক বিজন বনে পরিত্যক্ত হবার পর নবকুমার ক্ষুধা – তৃষ্ণায় কাতর হয়ে লোকালয় সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পথ চলতে থাকে । এমতাবস্থায় বহুদূরে আলোকশিখা দেখে কাছে অবশ্যই মানুষ রয়েছে — এই আশায় ভর করে সে সেদিকে চলতে থাকে । 

আলোর কাছে গিয়ে দেখে গলিত শবের উপর বসে হোমাগ্নি জ্বেলে এক কাপালিক ধ্যান করছে । নবকুমার অস্থি , নরকঙ্কাল , কপালি , শব , কারণবারি ও অগ্নিবেষ্টিত কাপালিককে নিরীক্ষণ করতে থাকে । 

( ঙ ) নবকুমার কার সহায়তায় কেমন করে পুনরায় পর্ণকুটীরে পৌঁছতে পেরেছিল ? 

উত্তরঃ নবকুমার কপালকুণ্ডলার সহায়তায় পর্ণকুটিরে পৌঁছতে পেরেছিল। 

( চ ) কাপালিকের পর্ণকুটিরের যথাযথ পরিচয় দাও । 

উত্তরঃ কেয়াপাতায় কাপালিকের কুটির তৈরি । সেই ঘরে ব্যাঘ্রচর্ম , এক কলস জল ও কিছু ফলমূল ছিল । কাপালিকের পর্ণকুটির ছিল এক ঘন বনের ভিতর । সেখানে ছিল না জনমানবের চিহ্ন । 

( ছ ) কাপালিকের পর্ণকুটিরে নবকুমার কী করে কোথায় প্রাপ্ত তণ্ডুল আত্মসাৎ করেছিল ? 

উত্তরঃ নবকুমার দেখে কাপালিকের পর্ণকুটিরে পাকোপযোগী কিছু কিছু সামগ্রী রয়েছে । নবকুমার বিস্মিত না হয়ে মনে করে এটা কাপালিকের কর্ম । নবকুমার তার তণ্ডুলগুলি কুটির মধ্যে এক মৃৎপাত্রে সিদ্ধ করে আত্মসাৎ করেছিল । 

( জ ) “ কোথা যাইতেছ ? যাইও না । ফিরিয়া যাও — পলায়ন করো । ” — উক্তিটি কার ? কে , কাকে , কখন , কেন এ উক্তি করে ? নবকুমার পরে কী করল ? 

উত্তরঃ কপালকুণ্ডলা বলেছিল । নবকুমারকে বলেছিল । কাপালিকের সঙ্গে পরদিন নবকুমারের দেখা হলে নবকুমার গৃহে ফিরতে কাপালিকের সাহায্য চাইলে কাপালিক সে বিষয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে নবকুমারকে বধ হেতু পূজাস্থানে নিয়ে যাবার সময় কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে রক্ষা হেতু এই উক্তি করেছিল । এরপর নবকুমার যখন বোঝে শারীরিক শক্তিতে কাপালিকের সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব তখন সে বুদ্ধি খাটিয়ে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টা করেছিল । 

প্রশ্ন ৩। শূন্যস্থান পূরণ করো : 

( ক ) যে তো আশঙ্কাসূচক , কিন্তু ______ ? ______  

সকলই করিতে পারে । ? তবে কি ______  পলাইব বা ______ ? 

উত্তরঃ সে তো আশঙ্কাসূচক , কিন্তু কিসের আশঙ্কা ? তান্ত্রিকেরা সকলই করিতে পারে । তবে কি পলাইব ? পলাইব বা কেন

( খ ) নবকুমার কহিলেন “ এ পর্যন্ত ______ দর্শনে কি জন্য ______ ছিলাম ? ” কাপালিক কহিল ______ নিযুক্ত ছিলাম । 

উত্তরঃ নবকুমার কহিলেন , “ এ পর্যন্ত প্রভুর দর্শনে কি জন্য বঞ্চিত ছিলাম ? ” কাপালিক কহিল “ নিজব্রতে নিযুক্ত ছিলাম । ” 

( গ ) ভ্রমণ করিতে করিতে ______

শ্রম জন্মিল । ______ অনাহার ; এজন্য ______ হইলেন । 

উত্তরঃ ভ্রমণ করিতে করিতে নবকুমারের শ্রম জন্মিল । সমস্ত দিন অনাহার ; এজন্য অধিক অবসন্ন হইলেন । 

( ঘ ) ______ হইতে জানু পর্যন্ত ______ আবৃত । গলদেশে  ______ ।

উত্তরঃ কটিদেশ হইতে জানু পর্যন্ত শাৰ্দ্দুলচৰ্ম্মে আবৃত । গলদেশে রুদ্রাক্ষমালা । 

( ঙ ) পরে ______ শয়ন করিলেন , সমস্ত ______ শীঘ্রই ______ হইলেন । 

উত্তরঃ পরে ব্যাঘ্রচর্ম্মে শয়ন করিলেন , সমস্ত দিবসজনিত ক্লেশহেতু শীঘ্রই নিদ্রাভিভূত হইলেন । 

প্রশ্ন ৪। রচনাধর্মী উত্তর দাও : 

( ক ) “ পথিক , তুমি পথ হারাইয়াছ ? ” — উক্তিটির আলোকে ঘটনার পূর্বাপর আলোচনা করো । 

উত্তরঃ আকবর বাদশাহের রাজত্বের শেষ সময়ে পর্তুগীজ ও অন্যান্য নাবিক দস্যুদের ভয়ে যাত্রীনৌকা দলবদ্ধ হয়ে যাতায়াত করাই প্রথা ছিল। সপ্তগ্রাম নিবাসী নবকুমার শর্মা একবার গঙ্গাসাগরে তীর্থদর্শনে গিয়েছিল । ফেরার সময় তাদের নৌকা ঘোরতর কুয়াশায় সঙ্গীহীন হয়ে পড়েছিল । রোদ উঠলে তারা দেখতে পায় , তারা রসুলপুরের নদীর মোহনায় এসে পড়েছে । সেখানে সমুদ্রের মতই নদীর বিস্তার । তারা সমুদ্রের পশ্চিমতটের কাছে এসে পড়েছিল । সেখানে তাদের নৌকা বাঁধা হল । জোয়ারের দেরী দেখে আরোহীরা সম্মুখের সমুদ্রসৈকতে রান্নাবান্না করার জন্য নামে । কিন্তু নৌকায় রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ ছিলো না । বাঘের ভয়ে কেউ বনের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহস করল না । সাহসী যুবক নবকুমার তখন একা কাঠ আনতে যায় । কাঠ যোগাড় এবং বহন করে আনতে নবকুমারের কিছু দেরী হয় । তার মধ্যে জোয়ার এসে পড়ায় নাবিকেরা নৌকা ছেড়ে দেয় এবং জোয়ারের তীব্র বেগে নৌকা বহুদূর চলে যায় । প্রতিবেশী এবং সহযাত্রী সকলের নবকুমারের কথা মনে থাকলেও নৌকা নবকুমারকে ছেড়ে সপ্তগ্রামে ফিরে আসে। প্রচারিত হয় নবকুমারকে বাঘে হত্যা করেছে । 

নবকুমার অনেক কষ্টে কাঠ নিয়ে ফিরে এসে দেখে নৌকা নেই । নৌকা ফিরে আসবে এই আশায় সে সারাদিন সেখানে অপেক্ষা করতে থাকে । নবকুমার দেখে “ গ্রাম নাই , আশ্রয় নাই , লোক নাই , আহার্য নাই , পেয় নাই , নদীর জল অসহ্য লবণাত্মক ; অথচ ক্ষুধা – তৃষ্ণায় তাঁহার হৃদয়বিদীর্ণ হইতেছিল । ” নবকুমার মনে মনে বোঝে তার প্রাণনাশই নিশ্চিত । নানা চিন্তায় অস্থির নবকুমার এদিক ওদিক ভ্রমণ করতে থাকে । ক্রমে অন্ধকার হয় । বসে ভ্রমণ করতে করতে নবকুমারের দেহ অবসন্ন হয়ে পড়ে । সে বালিয়াড়ির পাশে এক জায়গায় বসে । সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুম যখন ভাঙে তখন অনেক রাত । বাঘের ভয়ে সেও ভীত হয়ে এদিক ওদিক নিরীক্ষণ করে দেখতে থাকে । হঠাৎ বহুদূরে আলো দেখে নবকুমার তাড়াতাড়ি সেখানে উপস্থিত হয় । দেখে এক কাপালিক যোগাসীন । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কাপালিক তাকে তার পর্ণকুটিরে নিয়ে যায় । নবকুমার সামান্য ফলমূল আহার করে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে । 

পরদিন ক্ষুধায় কাতর নবকুমার ফলান্বেষণে বের হয় । একটি গাছের খুব সুস্বাদু ফল খেতে নিবিড় বনমধ্যে সে পথ হারিয়ে ফেলে , কিছুক্ষণ পরে সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হয় । বসে বসে সে সমুদ্রের অনন্ত শোভা দেখতে থাকে । সন্ধে ঘনিয়ে আসে । হঠাৎ নবকুমার সেখানে এক অপূর্ব রমণী মূর্তি দেখে হতবাক হয় । অনেকক্ষণ পরে সেই তরুণী জিজ্ঞেস করে , “ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ? ” কোনো উত্তর না পাওয়ায় সে আবার বলে , “ আইস ” । নবকুমার তরুণীর পিছনে পিছনে চলল , কিন্তু কাপালিকের কুটিরের কাছে এসেই সুন্দরী বনের মধ্যে চলে গেল । 

কুটিরে কাপালিকের সঙ্গে নবকুমারের সাক্ষাৎ হয় । কাপালিক নবকুমারকে সঙ্গে নিয়ে চলে । নবকুমার ভাবে তার বাড়ি যাবার কোনো উপায় হবে । কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ রমণী নবকুমারের পিঠে স্পর্শ করে মৃদুস্বরে বলে— “ কোথা যাইতেছ ? যাইও না , ফিরিয়া যাও — পলায়ন কর । ” নবকুমার কিছুই বুঝতে পারল না । কাপালিককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তাকে বলি দেওয়ার জন্য পুজোর জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । তান্ত্রিকের পুজোয় নরমাংসের প্রয়োজন । পুজোর জায়গায় কাপালিক নবকুমারকে কতগুলি শুকনো , কঠিন লতাগুল্ম দিয়ে দৃঢ়ভাবে বেঁধে সমুদ্র সৈকতে ফেলে রাখে । নবকুমার নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় । কাপালিক বলির প্রাথমিক কাজ শেষ করে খড়গ নেওয়ার জন্য আসন ত্যাগ করে দেখে সেখানে খড়গ নেই । কপালকুণ্ডলাকে বারবার ডেকেও কোনো উত্তর পেল না । তখন কাপালিক বাড়ির দিকে যায় । ইতিমধ্যে কপালকুণ্ডলা খড়গ দিয়ে নবকুমারের বাঁধন খুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যায় । কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে নিয়ে নিভৃত বনের মধ্যে এক মন্দিরে অধিকারীর আশ্রয় নেয় । অধিকারী কপালকুণ্ডলাকেও আর কাপালিকের কাছে ফিরতে দিল না । কারণ সেখানে গেলে তার আর রক্ষা থাকবে না । নবকুমারের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়ে অধিকারী পরদিন তাদের মেদিনীপুরের পথ পর্যন্ত রেখে আসে । 

S.L. No.সূচীপত্র
অধ্যায় -১প্রার্থনা
অধ্যায় -২বিজয়া দশমী
অধ্যায় -৩গ্রাম্যছবি
অধ্যায় -৪প্রতিনিধি
অধ্যায় -৫আবার আসিব ফিরে
অধ্যায় -৬সাগর-সঙ্গমে নবকুমার
অধ্যায় -৭বাংলার নবযুগ
অধ্যায় -৮বলাই
অধ্যায় -৯আদরণী
অধ্যায় -১০তোতাকাহিনি
অধ্যায় -১১অরুণিমা সিনহা: আত্মবিশ্বাস ও সাহসের এক নাম
অধ্যায় -১২কম্পিউটার কথা, ইন্টারনেট কথকতা
অধ্যায় -১৩এসো উদ্যোক্তা হই
অধ্যায় -১৪জীবন সংগীত
অধ্যায় -১৫কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
অধ্যায় –১৬পিতা ও পুত্ৰ
অধ্যায় -১৭অরণ্য প্রেমিক: লবটুলিয়ার কাহিনি
অধ্যায় –১৮শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ
অধ্যায় -১৯উজান গাঙ বাইয়া
বাংলা ব্যাকরণ
S.L. Noবৈচিত্রপূর্ণ আসাম
অধ্যায় -১তিওয়াগণ
অধ্যায় -২দেউরিগণ
অধ্যায়নেপালিভাষী গোর্খাগণ
অধ্যায়বোড়োগণ
অধ্যায়মটকগণ
অধ্যায়মরাণগণ
অধ্যায়মিসিংগণ
অধ্যায়মণিপুরিগণ
অধ্যায়রাভাগণ
অধ্যায়১০চুটিয়াগণ

( খ ) ‘ সাগর সংগমে নবকুমার ’ পাঠটির সারাংশ লেখো । 

উত্তরঃ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় “ কপালকুণ্ডলা ” উপন্যাসটি । এটি ঐতিহাসিক রোমান্স হিসেবে পাঠকমহলে পরিচিতি লাভ করে।

গঙ্গাসাগর তীর্থদর্শন সেরে ফেরার সময় ঘন কুয়াশায় নবকুমারদের নৌকা সঙ্গ হীন হয়ে পড়েছিল । রোদ উঠলে দেখতে পায় তারা রসুলপুরের নদীর মোহনায় এসে পড়েছে । সেখানে সমুদ্রের মতই নদীর বিস্তার । তারা সমুদ্রের পশ্চিমতটের কাছে এসে পড়েছিল । জোয়ারের দেরী দেখে আরোহীরা সমুদ্র সৈকতে রান্নাবান্না করার জন্য নামে । কিন্তু রান্নার জন্য কাঠের অভাব ছিল । বাঘের ভয়ে কেউ বনের মধ্যে প্রবেশ করল না । সাহসী নবকুমার একাই কাঠ আনতে যায় । নবকুমার বহু কষ্টে কাঠ নিয়ে ফিরে এসে বহু নৌকা নেই । 

নৌকা ফিরে আসবে এই আশায় সে সারাদিন অপেক্ষা করতে থাকে । নবকুমার দেখে— “ গ্রাম নাই , আশ্রয় নাই , লোক নাই , আহার্য নাই , পেয় নাই , নদীর জল অসহ্য লবণাত্মক ; অথচ ক্ষুধা তৃষ্ণায় তাঁহার হৃদয়বিদীর্ণ হইতেছিল । নবকুমার মনে মনে ভাবে তার প্রাণনাশই নিশ্চিত । নানা চিন্তায় অস্থির নবকুমার এদিক ওদিক ভ্রমণ করতে থাকে । ক্রমে অন্ধকার হয় , ভ্রমণ করতে করতে নবকুমারের দেহ অবসন্ন হয়ে পড়ে । এক জায়গায় সে বালিয়াড়ির পাশে বসে । সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে । যখন ঘুম ভাঙে তখন অনেক রাত । 

বাঘের ভয়ে সেও ভীত হয়ে এদিক ওদিক নিরীক্ষণ করতে থাকে । হঠাৎ অনেক দূরে একটা আলো দেখতে পায় । আলো দেখে নবকুমারের বেঁচে থাকবার আশা পুনরায় জাগ্রত হয় । উঠে আলোর উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে । আলোর কাছাকাছি পৌঁছে দেখে যে একটি অল্প উঁচু বালির স্তুপের উপর আলো জ্বলছে এবং তার সামনে দেখা যাচ্ছে ছবির ন্যায় স্থির একটি মানুষকে । নবকুমার সেইদিকে দ্রুতবেগে চলতে শুরু করে । চিত্রপটের ন্যায় বসে থাকা মানুষটির কাছে পৌঁছে নবকুমার চিন্তিত হয়ে পড়ে । 

বালিস্তুপের শিখরে বসে থাকা মানুষটি চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছিল । নবকুমার ধ্যানস্থ মানুষটির সামনে হাজির হয়ে রোমাঞ্চিত হয় । চলে আসবে অথবা তাঁর কাছে থাকবে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না । শিখরে আসীন মানুষটি চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছিল । নবকুমারকে প্রথমে দেখতে পেল না । নবকুমার দেখলো —মানুষটির বয়স ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে । কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত বাঘের চামড়া পরিহিত । গলায় রুদ্রাক্ষের মালা , মুখ গোফদাড়িতে পরিপূর্ণ । সম্মুখে কাঠে আগুন জ্বলছে। গলে যাওয়া একটি শবদেহের উপর বসে রয়েছেন । চারিদিকে অসংখ্য নরমুণ্ড , হাড় , কঙ্কাল পড়ে রয়েছে । নবকুমার বুঝতে পারে এ ব্যক্তি কাপালিক । 

অনেকক্ষণ পর খিদে – তৃষ্ণায় কাতর নবকুমারকে কাপালিক নিজের পাতার কুটিরে নিয়ে যায় । সেখানে নবকুমারকে খাওয়ার জন্য কাপালিক কিছু ফলমূল দেয় । যাওয়ার আগে কাপালিক বলে যায় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত নবকুমার যেন চলে না যায় । নবকুমার ফলমূল খেয়ে বাঘের চামড়ার উপর শুয়ে পড়ে । 

পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও নবকুমার কাপালিকের দেখা পেল না । নবকুমার কুটির ত্যাগ করে ফলমূলের আশায় বালিস্তপের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে থাকে । ঘুরতে ঘুরতে নবকুমার বনের মধ্যে প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ফেলে । এমন সময় সাগরের গর্জন শুনতে পায় এবং শীঘ্রই সাগরের দেখা পায় । নবকুমার সাগরের পারে বহুক্ষণ বসে থাকে । ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই একটি অপূর্ব সুন্দরী নারীকে দেখতে পায় । এই দুর্গম বনের মধ্যে এমন দেবীমূর্তি দেখে নবকুমারের শরীর অবশ হয়ে যায় । কিছুক্ষণ বাক্-শক্তি বন্ধ হয়ে থাকে । বহুক্ষণ পর তরুণী মৃদুস্বরে বলে— “ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ? ” কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার বলে— “ আইস ” । নবকুমার তরুণীর পিছনে পিছনে , চলে , কিন্তু কাপালিকের কুটিরের কাছে এসেই সুন্দরী রমণী বনের মধ্যে চলে যায় । 

কুটিরে কাপালিকের সঙ্গে নবকুমারের সাক্ষাৎ হয় । কাপালিক নবকুমারকে সঙ্গে নিয়ে চলে । নবকুমার ভাবে তার বাড়ি যাবার কোনো উপায় হবে । কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ রমণী নবকুমারের পিঠে স্পর্শ করে মৃদুস্বরে বলে —— “ কোথা যাইতেছ ? যাইও না , ফিরিয়া যাও পলায়ন কর । ” নবকুমার কিছুই বুঝতে পারল না । কথা বলেই রমণী সরে যায় । প্রত্যুত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করল না । নবকুমার কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । রমণী কোনদিকে গেল কিছুই বুঝতে পারল না । মনে মনে ভাবতে থাকে — “ এ কাহার মায়া ? না আমারই ভ্রম হইতেছে । যে কথা শুনিলাম সে তো আশঙ্কাসূচক , কিন্তু কিসের আশঙ্কা ? তান্ত্রিকেরা সকলই করিতে পারে । তবে কি পলাইব ? পলাইব বা কেন ? সে দিন যদি বাঁচিয়াছি , আজিও বাঁচিব । কাপালিক মনুষ্য , আমিও মনুষ্য । ” 

( গ ) “ এ কি দেবী — মানুষ — না কাপালিকের মায়া মাত্র ” —এই উক্তিটির আলোকে নবকুমারের মনোভাব ব্যক্ত করো । 

উত্তরঃ কপালকুণ্ডলাকে কেন্দ্র করেই ‘ কপালকুণ্ডলা ’ উপন্যাসের কাহিনির বিস্তার । তার চরিত্রও উপন্যাসের মুখ্য বিষয় । অপর যা কিছু আলোচিত হচ্ছে তা কপালকুণ্ডলার কাহিনির পক্ষে প্রয়োজনীয় বলেই করা হচ্ছে । উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো কপালকুণ্ডলা । কিন্তু কপালকুণ্ডলার পরেই যার গুরুত্ব সে হলো নবকুমার । এছাড়া সে কেন্দ্রীয় চরিত্র কপালকুণ্ডলার স্বামীও বটে । এই সমস্ত কথা বিবেচনা করে নবকুমারকে উপন্যাসটির নায়ক বলে অভিহিত করতে হয় । 

নবকুমারকে নিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়েছিল । নবকুমার প্রকৃতিসৌন্দর্যে মুগ্ধ , উদারচেতা , পরোপকারী এবং সাহসী যুবকরূপে পাঠকদের কাছে পরিচিত হয় । নৌকারোহীদের ক্ষুদ্রতার পরিপ্রেক্ষিতে নবকুমারের স্বাতন্ত্র্য শুরুতে আমাদের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে । সমুদ্রতীরে পরিত্যক্ত হয়ে তার ব্যাকুলতা , কাপালিকের বিভীষণ আচরণে ভয়মিশ্রিত কিছুর আকর্ষণ , নিরুপায় অবস্থায় কাপালিক নির্দিষ্ট কুটিরে রাত্রিযাপন তাকে কোনো এ্যাডভেঞ্চার কাহিনির নায়ক বলে মনে করায় । কিন্তু সে স্বতন্ত্র। নবকুমার প্রকৃতির ভীমকান্ত সৌন্দর্যে আত্মহারা । 

ভয়ের সম্ভাবনাও তখন তাকে ফেরাতে পারে না । কাপালিকের আলয় থেকে বনে এবং বন থেকে বেরিয়ে সমুদ্রতীরে উপস্থিত হয়ে তার হৃদয়ের যে ভাব হয় তাতে চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য সম্যক প্রকাশিত হয় । নবকুমার এই পরিবেশে কপালকুণ্ডলাকে দেখতে পায় । কপালকুণ্ডলাকে দেখে নবকুমারের মনে যে ভাব জাগ্রত হয় তাকে প্রেম বলা চলে না । তা সব সত্তাকে আলোড়িত করা এক প্রচণ্ড বিস্ময় । এই জাতীয় সৌন্দর্য মানবীতে কি সম্ভব ? সব কামনাকে , চিত্রের অবতলে ঠেলে দিয়ে উঠে । তার মনে সৌন্দর্য উপলব্ধির যে ভাবটি জাগিয়ে তোলে তাকে মহিমান্বিত বলা চলে । 

কপালকুণ্ডলাকে দেখবার পরে নবকুমার যেন এই কঠোর বাস্তব জগৎ থেকে সৌন্দর্যলোকে চলে গেছে । তার চরিত্র কতকটা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে । সেজন্য লক্ষ্য করা যায় কাপালিক যখন তাকে বলি দেবার জন্য নিয়ে গেছে , জৈব প্রবৃত্তিবশে সে আপত্তি করলেও তা যেন মৃত্যুপথযাত্রীর তীব্র প্রতিরোধ বা দারুণ ভয় , আর্তনাদ প্রকাশ করে না। 

অবশেষে কপালকুণ্ডলার দ্বারা সে মুক্তিলাভ করে এবং পলায়ন করে । নবকুমারের সঙ্গে কপালকুণ্ডলার বিবাহ হয় । বিবাহের কথায় বা বিবাহকালেও নবকুমারের স্বপ্নমোহময় বিহ্বলতাই প্রধান হয়েছিল – নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম যেরূপ হয় সে ভাবটি এখানে লক্ষ্য করা যায়নি । 

উপন্যাসের এই প্রথম খণ্ডে নবকুমারকে বেশি করে পাওয়া যায় । কপালকুণ্ডলার আবির্ভাবের পর থেকে গোটা কাহিনির পশ্চাৎপট তার আবদ্ধ আগুলফলম্বিত কেশজালে পরিবেষ্টিত । সামনে সে প্রসঙ্গই গীত হউক , পেছনে ধ্রুপদটি কপালকুণ্ডলাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে । 

দ্বিতীয় খণ্ডে নবকুমার – মতিবিবি — বিশেষ করে মতিবিবিকেই আমরা সামনে দেখতে পেলেও মতিবিবির আচরণের সব চাঞ্চল্য ভেদ করে মৃত্তিকায় খোলা চুলে উপবিষ্টা কপালকুণ্ডলা যেন একটা মহিমা বিস্তার করে । দেখার যে বনভূমি ও সমুদ্রোপকূলের বাইরে এসে নবকুমারের স্বাভাবিক পার্থিব জ্ঞান কতকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছে । সে মতিবিবিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে । সে যেমন সপ্রতিভ তেমনি উদারচিত্ত । কপালকুণ্ডলা সম্পর্কে তার মনোভাবও বায়ুচারিতা পরিত্যাগ করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । কপালকুণ্ডলা তার পত্নী— তার সৌন্দর্য নিয়ে সে মতিবিবির কাছে গর্ব প্রকাশ করেছে । 

কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে নবকুমার ঘরে আসার পরে তার কপালকুণ্ডলার প্রতি প্রণয়ভাব স্পষ্ট প্রকাশিত । পূর্বের বিস্ময় বিহ্বলতার স্থানে মানবীর প্রতি মানব হৃদয়ের আকর্ষণ তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে । পরবর্তী খণ্ডে মতিবিবির জীবনের নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে । নবকুমার কপালকুণ্ডলার কথা গৌণ হয়ে পড়েছে । 

চতুর্থ খণ্ডে আমরা লক্ষ্য করি নবকুমার কপালকুণ্ডলার বিবাহিত জীবনের এক বৎসর অতিবাহিত । নবকুমার কপালকুণ্ডলার বিবাহিত জীবনের এক বৎসর কেটে গেলেও নবকুমার কপালকুণ্ডলার মনের থৈ পায়নি । বাইরে সে সাধারণ গৃহবাসী হলেও হৃদয়ের দিক থেকে কোন আসক্তি , কোনরূপে ঘনিষ্ঠ নৈকট্য সৃষ্ট হয়নি । নবকুমারের ভালোবাসা হৃদয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে তা কপালকুণ্ডলার প্রতি সস্নেহ বচনে প্রকাশিত । কিন্তু কপালকুণ্ডলার হৃদয় থেকে কোনো সাড়া জাগেনি । এর প্রতিক্রিয়া নবকুমারের হৃদয়ের গভীরে যে যন্ত্রণা – ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা আগে বিশ্লেষিত হয়নি । হঠাৎ কপালকুণ্ডলা অবিশ্বাসিনী আশঙ্কায় চিত্ত বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠেছে । 

এক বৎসরকাল দাম্পত্য জীবনে যে তৃষ্ণা এবং যে অভাব ঘনীভূত হয়েছিল , যে কামনা এবং যে অপ্রাপ্তির নিগূঢ় সংঘাত চলেছিল , তা এতকাল গোপনে তার অন্তরাত্মাকে করেছে ক্ষত – বিক্ষত । উপন্যাসের শেষে সাময়িক অপ্রকৃতিস্থতায় সেটাই আত্মপ্রকাশ করেছে । নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে নিজহাতে বলি দিতে উদ্যত । 

এর একমাত্র পরিণতি যা ঘটতে পারে সেটাই ঘটেছে । নবকুমারের বেঁচে থাকার ট্র্যাজেডি তার মৃত্যুতে পূর্ণতা লাভ করেছে । 

পরিশেষে , নবকুমারের চরিত্র পরিকল্পনা বিষয়ে মোহিতলাল মজুমদারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য , “ নবকুমার চরিত্রের এই সর্বাঙ্গীণ বলিষ্ঠতার পরিচয় আমরা কাহিনির প্রথমভাগেই পাই । শেষের দিকে তাহার এই পুরুষোচিত উদারতা ও সুস্থ বিচার – বুদ্ধির অভাবই লক্ষ্য করি । এইরূপ পরিণাম ট্র্যাজেডির নায়কের পক্ষে ঘটিয়া থাকে ; অধঃপতনের কারণও সেই চরিত্রের মধ্যে নিহিত থাকে । পুরুষ যতই মহৎ হোক তাহার মনুষ্যসুলভ দুর্বলতা থাকিবেই — কোনো না কোনো রন্ধ্রে শনি প্রবেশ করিয়া তাহার সেই মহত্বকে নিষ্ফল করিয়া দেয় । কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করার পর তাহার জীবনে যে নতুন একটি অবস্থার সূত্রপাত হইল— কপালকুণ্ডলার প্রতি তাঁহার সেই আকস্মিক ও অতিপ্রবল অনুরাগই তাহার চরিত্রের মূল ভিত্তি শিথিল করিয়া দিল । লেখক তাহার হৃদয়কে এই প্রেমের দ্বারা বিস্ফারিত করিতে চাহিয়াছেন — এ চরিত্রের পক্ষে তাহাই স্বাভাবিক বটে ; প্রেম এমন পুরুষকে আরও নিঃস্বার্থ , আরও শক্তিমান করিবে । কিন্তু নবকুমারের প্রেম ব্যাধিতে পরিণত হইল — একটা অস্বাভাবিক ক্ষুধার মত , রিপুর মত , তাহাকে আত্মভ্রষ্ট করিল । ” 

( ঘ ) “ কাপালিক মনুষ্য আমিও মনুষ্য ” —উক্তিটির বক্তা কে ? সে এরূপ বলার যথাযথ কারণ উল্লেখ করো । 

উত্তরঃ উক্তিটির বক্তা নবকুমার । মোহিতলাল মজুমদার কাপালিক চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন , “ কাপালিকের চরিত্র স্বাভাবিক বা সামাজিক মানবচরিত্র নয় ।… সে একপ্রকার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিবার আশায় সকল মনুষ্যসুলভ সংস্কার বিসর্জন দিয়াছে ; তাহার যে ইষ্ট – দেবতা তন্ত্রে তাহার নাম আছে ; সেই মহাশক্তিকে আরাধনায় তুষ্ট করিয়া সেও মহাশক্তিধর হইতে চায় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে একটা বিকৃতমস্তিষ্ক নরপিশাচে মাত্র পর্যবসিত হইয়াছে । তাহার সংস্কৃত ভাষায় কথোপকথন এবং একটি তত্ত্বকলার মত বচন শুনিয়া , তাহার অসীম দেহবল ও নিষ্ঠুর মনোবল দেখিয়া প্রথমে যেমন ভয় ও বিস্ময় জাগে পরে তাহার দূরবস্থা দর্শনে তেমনই ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার উদ্রেক হয় । একটা অমানুষিক সংকল্প সিদ্ধির জন্য তাহার যে একাগ্রতা , তাহাও যেন একটা ‘ fixed idea বা একপ্রকার মানসিক ব্যধির মত । গ্রন্থকার এ – চরিত্রে মনুষ্য প্রকৃতির বিকৃতিই বিশেষভাবে চিত্রিত করিয়াছেন , এ চরিত্র স্বাভাবিকও নয় , আবার স্বভাবকে অতিক্রম করার যে মহত্ত্ব তাহাও ইহাতে নাই । ” 

উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে লক্ষ্য করা যায় সমালোচকপ্রবরের উদ্ধৃত মন্তব্য কতটা সত্য । কাপালিকের চরিত্রের ভিত্তিতে তন্ত্রসাধনার আধ্যাত্মিক ভিত্তি রয়েছে । কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণের দিক থেকে তা কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার নয় । কোনো সাধনঘটিত সত্যের দিক থেকে উপন্যাসপাঠক তার চরিত্রটিকে দেখবেন না । তাকে একটি মানুষ হিসাবে বিচার করতে হবে । এই মানুষটি তন্ত্রসাধনায় বীরাচারের পন্থা গ্রহণ করেছিল । তা প্রাত্যহিক আবদ্ধ জীবন থেকে এত স্বতন্ত্র যে একটা ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকে প্রথম দিকে আমরা দেখি ।

নবকুমার যখন শবাসনে কাপালিককে প্রথম দেখে তখন তার মধ্যে ভয় ও বিস্ময় ছিল । শবকে যে আসন করেছে সে ভীষণ , নরকপালে যার তরল পানীয় আছে সে পিশাচসদৃশ। কিন্তু পিশাচকে আমরা যুগপৎ ভয় ও ঘৃণা করি । কাপালিককে ঘৃণা করতে পারি না । আতঙ্কের সঙ্গে অনেকটা বিরূপতা সেখানে মিশ্রিত কিন্তু তা ঠিক ঘৃণা নয় । 

উপন্যাসের প্রথমদিকে বঙ্কিমচন্দ্র নিষ্ঠুর কাপালিকের চরিত্রে একজাতীয় মহত্ত্ব দেখিয়েছেন । তার মধ্যে কোনরূপ চাঞ্চল্য নেই । দেবীর সম্মুখে বলি দেবার জন্য সে আর একটি মানুষ পেয়েছে — তার সিদ্ধি নিকটতর হল — এইরূপ ভাবনায় সে উল্লাস বোধ করে নি । একটা নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তি লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে । সে নবকুমারকে যখন বলি দিতে নিয়ে যায় , তখনও সে নবকুমারের প্রতি কোনোরূপ জিজ্ঞাসা পোষণ করেনি । যেন সম্পূর্ণ নিরাসক্ত চিত্তেই সে নবলব্ধ ব্যক্তিটিকে দেবী সম্মুখে অর্ঘ্যদান করতে চলেছে । 

আপনার উপরে তার সম্পূর্ণ আস্থা , দেবীর উপরে তার সুনিশ্চিত বিশ্বাস । তার মধ্যে সেজন্য একটা নিশ্চিত প্রশান্তি লক্ষ্য করা যায় । ভীষণের এই প্রশান্তি পাঠককে প্রথমভাগে বিমূঢ় করে তোলে । কিন্তু যে মুহূর্তে তার কাজে বাধা আসে , যখনই সে নবকুমারকে বধ করবার জন্যে খড়্গ খুঁজে পায় না তখনই তার নিশ্চিন্ততা দূর হল । সে চঞ্চল হয়ে উঠে । খড়গ পেল এবং পরে যখন নবকুমার এবং অপরাধিনী কপালকুণ্ডলাকে পেল না তখন তার চারিত্রিক নৈর্ব্যক্তিকতার সম্পূর্ণ অবসান ঘটল । 

এরপরে কাপালিক যখন বালিয়াড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলে , তার দৈহিক সামর্থ্যের সম্পূর্ণ লোপ ঘটে । ফলে তার চরিত্র এতকাল যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল , মনে মনে যে আশা সে পোষণ করেছিল তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভের তা সবই সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় । কাপালিকের চরিত্রে যেটুকু বড় ব্যাপার ছিল তা লুপ্ত হয় এবং সব দোষত্রুটি প্রকট হয়ে উঠে । কাপালিকের আচরণের পৈশাচিকতা এবং নীচতা দেখা দেয় , তীব্র প্রতিহিংসার রূপ ধরে সে কপালকুণ্ডলাকে নিধন করবার সংকল্প গ্রহণ করে । আভিচারিক প্রক্রিয়ায় তা সিদ্ধ হয় না । তখন সে কোনো পুরুষের সাহায্য গ্রহণের চেষ্টা করে । উপন্যাসের শেষ প্রান্তে হীন ষড়যন্ত্রকারীরূপে তাকে দেখতে পাওয়া যায় । কিন্তু প্রথমাংশের কাপালিক চরিত্রের এই জাতীয় পরিণতি মনস্তত্ত্বের পথ ধরেই ঘটেছে । সূচনাপর্বের কাপালিক চরিত্র আর সমাপ্তি পর্বের কাপালিকের মধ্যে আন্তর – সংগতি আছে ।

( ঙ ) নবকুমারকে গল্পটির নায়ক বলা যায় কি ? নবকুমারের চরিত্রের বর্ণনা দাও । 

উত্তরঃ কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নায়ক নবকুমার , অবশ্য তাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়নি । উপন্যাসের প্রথমদিকে তাকে বরং আমরা একটু সক্রিয় দেখি কিন্তু সপ্তগ্রামে ফিরে আসার পরই নবকুমার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে । তাই রবীন্দ্রনাথ রাজসিংহ উপন্যাস সম্বন্ধে যা বলেছিলেন আমরা কপালকুণ্ডলা উপন্যাস সম্বন্ধে তা বলতে পারি । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , “ রাজসিংহ উপন্যাসে নায়ক আছে কিনা জানি না , তবে নায়িকা জেবউন্নিসা । কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নায়ক নবকুমার নামমাত্র , নায়িকা কপালকুণ্ডলাই প্রধান । ” 

নবকুমারকে নিয়েই উপন্যাসের শুরু । সেখানে নবকুমার ধীর , স্থির , সৌন্দর্যপ্রিয় এবং পরোপকারী এক যুবক । সপ্তগ্রাম নিবাসী এই ব্রাহ্মণকুমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে গঙ্গাসাগর তীর্থে গিয়েছিল পুণ্যলোভের জন্য নয় ; সমুদ্র সৌন্দর্য দেখার জন্য । যা সে দেখেছে তা জন্ম – জন্মান্তরেও ভোলবার নয় । ফিরে আসার সময় ঘন কুয়াশার জন্য মাঝি দিক ঠিক করতে পারল না । নৌকামধ্যে তখন মহা কোলাহল এবং আর্তনাদ উঠে কিন্তু নবকুমার তখনও অঞ্চলভাবে নাবিককে বলে— “ আশঙ্কার বিষয় কিছু নাই , প্রভাত হইয়াছে — চার পাঁচ দণ্ডের মধ্যে অবশ্য সূর্যোদয় হইবে । চার পাঁচ দণ্ডের মধ্যে নৌকা কদাচ মারা যাইবে না । তোমরা এক্ষণে বাহন বন্ধ কর , স্রোতের নৌকা যথায় যায় যাক ; পশ্চাৎ রৌদ্র হইলে পরামর্শ করা যাইবে । ” 

পরপর নৌকা নিরাপদ হলে আরোহীরা সৈকতে ‘ পাকাদি ’ সমাপন করতে তৎপর হয় কিন্তু নৌকায় রান্নার কাঠ ছিল না । বাঘের ভয়ে কেউ বন থেকে কাঠ আনতেও সাহস করেনি । তখন নবকুমার একাই বনে কাঠ আনতে যায় । কাঠের জন্য তাকে বনের ভেতরে বহুদূরে যেতে হল । “ নবকুমার দরিদ্রের সন্তান ছিলেন না । এসকল কার্যে অভ্যাস ছিল না ; সম্যক বিবেচনা না করিয়া কাষ্ঠ আহরণে আসিয়াছিলেন কিন্তু এক্ষণে কাষ্ঠ ভার বহন বড় ক্লেশকর হইল । যাহাই হউক যে কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন , তাহাতে অল্পে ক্ষান্ত হওয়া নবকুমারের স্বভাব ছিল না । ” নবকুমার ফিরে এসে দেখে সহযাত্রীরা তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে । কিন্তু সে ঠিক প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি । কারণ এরকম কাজ মানুষ করতে পারে নবকুমারের কাছে তা ছিল কল্পনাতীত। 

এই বিশ্বাসই নবকুমারের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । সে সহযাত্রীদের বিশ্বাস করেছিল । পরে শবাসনে যোগাসীন কাপালিককেও বিশ্বাস করে । কাপালিক নিশ্চয়ই তাকে বাড়ি ফেরার কোনো উপায় করে দেবে সেই আশায় কাপালিকের সঙ্গ ছাড়ল না । নয়তো কাপালিকের নৃশংস প্রকৃতির কথা জানলেও সে পালাতে পারত । কপালকুণ্ডলাকেও সে বিশ্বাস করেছিল । কিন্তু যে মুহূর্তে বোঝে কপালকুণ্ডলা অবিশ্বাসিনী হয়েছে তখন থেকে সে আত্মপীড়ায় দগ্ধ হয়েছে । নিজের সর্বনাশ নিজে করেছে । ব্রাহ্মণবেশীর পত্র পড়ে নবকুমারের বিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙ্গে যায় । নবকুমার প্রথমে বুঝতে পারল না পরে সংশয় , পরে নিশ্চয়তা শেষে জ্বালা । “ মনুষ্য হৃদয় ক্লেশাধিক্য বা সুখাধিক্য একেবারে গ্রহণ করিতে পারে না , ক্রমে ক্রমে গ্রহণ করে । 

নবকুমারকে প্রথমে ধূমরাশি বেষ্টন করিল ; পরে বহ্নিশিখা হৃদয় তাপিত করিতে লাগিল , শেষ বহ্নির রাশিতে হৃদয় ভস্মীভূত হইতে লাগিল । ইতিপূর্বেই নবকুমার দেখিয়াছিলেন যে , কপালকুণ্ডলা কোনো কোনো বিষয়ে তাঁহার অবাধ্য হইয়াছেন । বিশেষ কপালকুণ্ডলা তাঁহার নিষেধ সত্ত্বেও যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে একাকিনী যাইতেন ; যাহার তাহার সহিত যথেষ্ট আচরণ করিতেন ; অধিকন্তু তাঁহার বাক্য হেলন করিয়া নিশীথে একাকিনী বনভ্রমণ করিতেন । আর কেহ ইহাতে সন্ধিহান হইত , কিন্তু নবকুমারের হৃদয় কপালকুণ্ডলার প্রতি সন্দেহ উত্থাপিত হইলে চিরনির্বাহ বৃশ্চিক দংশনবৎ হইবে জানিয়া , তিনি একদিনের তরে সন্দেহকে স্থান দান করেন নাই । অদ্যত্ত সন্দেহকে স্থান দিতেন না , কিন্তু অদ্য সন্দেহ নহে , প্রতীতির আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে । ” তার ফলে নবকুমারের মনে তীব্র বেদনাবোধ দেখা দিয়াছে । সে নীরবে বসে অনেকক্ষণ রোদন করে ।

নবকুমার ভাগ্য বিড়ম্বিত । সে রামগোবিন্দ ঘোষালের কন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করেছিল । বিবাহের পর পদ্মাবতী কিছুদিন পিত্রালয়ে ছিল । মাঝে মাঝে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করত । যখন তার বয়স তের বছর তখন তার পিতা সপরিবারে পুরুষোত্তম দর্শনে গিয়েছিলেন । ফেরার সময় তিনি পাঠান সেনার হাতে পড়েন এবং সপরিবারে মুসলমান হয়ে নিষ্কৃতি পান । তখন নবকুমারের পিতা জীবিত ছিলেন । তিনি জাতিভ্রষ্টা বৈবাহিকের সঙ্গে জাতিভ্রষ্টা পুত্রবধূকেও ত্যাগ করলেন । নবকুমারের সঙ্গে তার স্ত্রী পদ্মাবতীর আর দেখা হল না । নবকুমার বিরাগবশতঃ আর বিবাহ করেনি । 

প্রায় চোদ্দ বছর পর পথহারা নবকুমার সাগরকূলে সন্ধ্যালোকে কপালকুণ্ডলার মোহিনী রূপ দেখে মুগ্ধ হয় । কপালকুণ্ডলা যখন তাকে বলল — “ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ? ” এখন তার “ হৃদয়বীণা বাজিয়া উঠিল । ” “ সাগর – বসনা পৃথিবী সুন্দরী ; রমণী সুন্দরী ; ধ্বনিও সুন্দরী ; হৃদয়তন্ত্রী মধ্যে সৌন্দর্যের লয় মিলিতে লাগিল । ” নবকুমার কুটিরে ফিরেও নিষ্পন্দ হৃদয়ে ভাবতে লাগল — “ এ কি দেবী —— মানুষী – না কাপালিকের মায়ামাত্র । ” পরদিন নবকুমার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই সমুদ্রতীরে সেই মোহিনী নারীকে দেখার জন্য অস্থির হৃদয়ে অপেক্ষা করল । কিন্তু কাপালিক যখন তাকে রাত্রে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে চলল তখন আবার সেই রমণীকে দেখে নবকুমার বিস্মিত হল । 

পরে সেই মোহিনী কপালকুণ্ডলাই তাকে কাপালিকের হাত থেকে উদ্ধার করে পালাবার সময় অধিকারীর কাছে নিয়ে আসে । অধিকারী তখন নবকুমারকে কপালকুণ্ডলার প্রাণরক্ষার কোনো উপায় বিবেচনা করতে বলে । নবকুমার বলে— “ আমার প্রাণদান করিলে যদি কোনো প্রত্যুপকার হয় , তবে তাহাতেও প্রস্তুত আছি । ” সে অধিকারীর প্রস্তাবে কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করতে সম্মত হয় । এমনকি যদি কপালকুণ্ডলার জন্য সংসার ত্যাগ করতে হয় তাও করতে সে প্রস্তুত । নবকুমার কপালকুণ্ডলার যত্নের কোনো ত্রুটি করল না । অধিকারীর দেওয়া ধনবলে কপালকুণ্ডলার জন্য একজন দাসী , একজন রক্ষক ও শিবিকাবাহক নিযুক্ত করে তাকে শিবিকারোহণে পাঠাল । অর্থাভাব নিজে হেঁটে পথ চলল ।

নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে স্বদেশে উপস্থিত হয় । নবকুমার পিতৃহীন , তার বিধবা মা বাড়িতে ছিলেন , আর ছিল দুই বোন । অজ্ঞাতকুলশীলা কপালকুণ্ডলা তার বাড়িতে সাদরেই গৃহীতা হল দেখে নবকুমার খুবই আনন্দিত হয় । অনাদরের ভয়ে সে এ পর্যন্ত কপালকুণ্ডলার কাছে কোনো আহলাদ বা প্রণয় প্রকাশ করেনি । কিন্তু সেই আশঙ্কা দূর হওয়ায় “ নবকুমারের প্রণয় সিন্ধু উথলিয়া উঠিল । ” তার কাছে ‘ সকল সংসার সুন্দর বোধ হইল । ‘ কিন্তু এক বছরের বেশি তার সেই আনন্দ স্থায়ী হয়নি । তার বনচারী ‘ বউ ’ সংসার মন টিকিয়ে থাকতে পারেনি । প্রকৃতি পালিতা কপালকুণ্ডলা প্রকৃতির বুকেই বিলীন হয়ে গেল । সঙ্গে সঙ্গে নবকুমারের জীবনও শেষ হয়ে গেল । নবকুমারের ভাগ্য বিড়ম্বনার শেষ হল । 

নবকুমার কপালকুণ্ডলার দাম্পত্য জীবনের চিত্র বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের কাছে উপস্থিত করেন নিঃআভাসে ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন । তবে যতদূর জানা যায় নবকুমারের মধ্যে রূপাসক্তিই ছিল প্রবল । সমুদ্রকূলে কপালকুণ্ডলার মোহিনী রূপ দেখেই নবকুমারের চিত্ত ব্যাকুল হয়েছিল । তারপর স্বগৃহে কপালকুণ্ডলা সাদরে গৃহীত হওয়ায় বাঁধভাঙা স্রোতের মতো তার হৃদয় তখন আনন্দে ভরে উঠে । কিন্তু তার এই প্রেম রূপজ । শ্যামাসুন্দরীর স্বামীকে বশ করার জন্য রাতে ওষুধ – তুলতে যাওয়ার সময় নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে নিষেধ করেছে । 

কপালকুণ্ডলার কাছে ব্রাহ্মণবেশীর পত্র পড়ে নবকুমার ঈর্ষায় দগ্ধ থাকে লাগল । ব্রাহ্মণবেশীকে কপালকুণ্ডলার উপপতি বলে মনে করে । কাপালিক তার এই সন্দিগ্ধ চিত্তকে বশীভূত করে তার কাছে লাগিয়েছিল। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে তার কান্নার কারণ সম্পর্কে বলেছে— “ তুমি কি জানিবে মৃন্ময় ! তুমি ত কখনও রূপ দেখিয়ে উন্মত্ত হও নাই ।… তুমি ত কখনও আপনার হৃৎপিণ্ড আপনি ছেদন করিয়া শ্মশানে ফেলিতে আইস নাই । ” অথচ একটু চেষ্টা করলেই বা কপালকুণ্ডলাকে জিজ্ঞাসা করলেই নবকুমার প্রকৃত কারণ জানতে পারত । এমনকি পদ্মাবতী যখন তাকে ভয় দেখাল তখন নবকুমারকে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ।

প্রকৃতপক্ষে নবকুমার ছিল অবিবেচক । ঝোঁকের মাথায় সে কাজ করে বসত । ‘ সম্যক বিবেচনা না করিয়া ’ সে কাঠ আনতে গিয়েছিল । সেজন্য তার ফিরতে দেরি হয়েছিল । অধিকারী কপালকুণ্ডলার প্রাণ রক্ষার কোনো উপায় বিবেচনা করতে বললে নবকুমার বলল “ আমি এমন সঙ্কল্প করিতেছি যে , আমি এই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্মসমর্পণ করি । তাহা হইলে ইহার রক্ষা হইবে । ” তখন অধিকারী হেসে বললেন , “ তুমি বাতুল । ইহাতে কি ফল দর্শিবে ? তোমারও প্রাণ সংহার হইবে — অথচ ইহার প্রতি মহাপুরুষের ক্রোধোপশম হইবে না । ” 

এই অবিবেচনাই নবকুমারের দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে । কপালকুণ্ডলার কাছে ব্রাহ্মণবেশীর পত্র পড়েই নবকুমার স্থির সিদ্ধান্ত করল , কপালকুণ্ডলা অবিশ্বাসিনী । ব্রাহ্মণবেশী তার উপপতি । তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যই কপালকুণ্ডলা রাত্রে বনে যায় । অথচ সে একবারও তা কপালকুণ্ডলাকে জিজ্ঞাসা করেনি । সে আত্মপীড়ন ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে কপালকুণ্ডলার পদতলে পড়ল । তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । কপালকুণ্ডলা প্রকৃত বৃত্তান্ত নবকুমারকে বলল কিন্তু আর বাড়ি ফিরল না । 

নবকুমারের এই অসহায়তা এবং আত্মনির্ভরতার অভাব কিন্তু পদ্মাবতীর সঙ্গে ব্যবহারের সময় দেখা যায় না । দস্যুদের হাতে নিগৃহীতা স্ত্রীলোককে নিজের কাঁধে তার ভর রেখে নিরাপদে চটিতে নিয়ে গেছে । তার ভাদ্রমাসের ভরা নদীর মতো অতি সুন্দর রূপলাবণ্য নবকুমার নিমেষশূন্য চোখে দেখেছিল । নবকুমার ভদ্রলোক । তাই স্ত্রীলোকটি যখন জিজ্ঞাসা করল “ আপনি কি দেখিতেছেন ? ” তখন অপ্রতিভ হয়ে সে মুখাবনত করল । পদ্মাবতী নবকুমারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সপ্তগ্রামে ফিরে আসল । তখন তার নাম লুৎফ – উন্নিসা । তার সঙ্গে নবকুমারের পুনরায় দেখা হল । সে নবকুমারের দাসী হয়ে থাকতে চায়। কিন্তু নবকুমার স্বীকৃত হল না । সে বলল , “ আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ , ইহজন্মে দরিদ্র ব্রাহ্মণই থাকিব । তোমার ধনসম্পদ লইয়া যবনীজার হইতে পারিব না । ” 

নবকুমার তখনও জানত না যে এই রমণী তাঁর পূর্বপত্নী । তাই সে বলল— “ তুমি যবনী পরস্ত্রী তোমার সহিত এরূপ আলাপও দোষ । তোমার সহিত আর আমার সাক্ষাৎ হইবে না । ” এখানে নবকুমারের এই সংস্কারই প্রধান । এই কারণেই রমণীর হৃদয়ের কাতর অনুরোধও সে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে । লুৎফ – উন্নিসা নবকমারের দুই পা ধরে কাতর স্বরে বলল “ নির্দয় ! আমি তোমার জন্য আগ্রার সিংহাসন ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি । তুমি আমায় ত্যাগ করিও না । ” নবকুমার বলল— “ তুমি আবার আগ্রাতে ফিরিয়া যাও । আমায় ত্যাগ কর । ” লুৎফ – উন্নিসা তখন দলিত ফণা ফণিনীর মত সদর্পে বলল , “ এজন্মে তোমার আশা ছাড়িব না । ” সেই মূর্তি দেখে নবকুমারের প্রথমা স্ত্রী পদ্মাবতীকে মনে পড়ল । 

যখন জানল এই লুৎফ – উন্নিসাই পদ্মাবতী তখন সে অন্যমনে শঙ্কান্বিত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল । কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা নবকুমারের সেই শঙ্কার পরিচয় পাই না । তার জন্য সে নিজেও কোনো সতর্কতা অবলম্বন করেনি । পরে এই পদ্মাবতীর ‘ ব্রাহ্মণবেশী ‘ নামে কপালকুণ্ডলার কাছে লেখা পত্রই নবকুমারের মনে সন্দেহের জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল । এখানে নবকুমারের সঙ্গে শেকসপীয়রের ওথেলোর তুলনা করা যায় । ডেসডিমনা খুব সঙ্কটমুহূর্তে তার রুমাল হারাল আর সেই রুমাল গিয়ে পড়ল ইয়াগোর হাতে । এর সহযোগিতায় ইয়াগো ওথেলোর মনে ডেসডিমনার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহকে দৃঢ় করল । 

ডেসডিমনার রুমাল হারানোর সঙ্গে কপালকুণ্ডলার পত্র হারানোর মিল আছে । কিন্তু ইয়াগো ওথেলোর মনে আগেই ডেসডিমনার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিল । নবকুমার আগে কপালকুণ্ডলাকে কেন সন্দেহ করল । প্রকৃতপক্ষে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের অভাবই নবকুমারের চরিত্রের বিপর্যয়ের কারণ । তার চরিত্রের বলিষ্ঠতা , আত্মনির্ভরতার অভাব তার চরিত্রকে ট্র্যাজিক করে তুলতে পারেনি । কপালকুণ্ডলার উপন্যাসে নবকুমার নিষ্ক্রিয় , কতকগুলি ঘটনার টানা পোড়েনে তার জীবন দোলায়িত । বঙ্কিমচন্দ্র তাকে সর্বগুণান্বিত নায়কের আদর্শে সৃষ্টি করেননি । কিন্তু তাকে দোষেগুণে মানবিক করেছেন । তার চরিত্রে কোনো জটিলতা নেই । তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবাবেগ ।

প্রশ্ন ৫। ব্যাখ্যা করো : 

( ক ) “ রাত্রি মধ্যে ব্যাঘ্র ভল্লুকের সাক্ষাৎ পাইবার সম্ভাবনা , প্রাণনাশই নিশ্চিত ” । 

উত্তরঃ অংশটি বঙ্কিমচন্দ্রের “ কপালকুণ্ডলা ” উপন্যাসের অন্তর্গত । সপ্তগ্রাম নিবাসী নবকুমার সমুদ্র – সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে গঙ্গাসাগরে গিয়েছিল । ফিরে আসার সময় ঘন কুয়াশার জন্য মাঝি দিক ঠিক করতে পারল না । নৌকার মধ্যে মহা কোলাহল শুরু হল । নৌকার আরোহীরা সমুদ্রসৈকতে রান্না করার জন্য চেষ্টা করলেও নৌকায় রান্নার জন্য কাঠ ছিল না । বাঘের ভয়ে বন থেকে কেউ কাঠ যোগাড় করতে যেতেও সম্মত হল না । তখন নবকুমার একাই বনে কাঠ যোগাড় করতে গেল । কাঠের জন্য তাকে বনের অনেক ভেতরে যেতে হল । নবকুমার ফিরে এসে দেখল সহযাত্রীরা তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। 

নৌকা ফিরে আসার আশায় নবকুমার বহুক্ষণ অপেক্ষা করল । কিন্তু নৌকা কিংবা নৌকারোহী কেউই এল না । নবকুমার ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল । সে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল । ক্রমে বেলা শেষ হয়ে গিয়ে সূর্যাস্ত হল । নৌকা ফিরে আসার হলে এতক্ষণ আসত । 

এতক্ষণে নবকুমার বুঝতে পারল তাঁকে ছেড়ে সবাই চলে গেছে । সে দেখল এখানে গ্রাম নেই , আশ্রয় নেই , লোক নেই , খাদ্য নেই , পানীয় জল নেই , নদীর জলে প্রচণ্ড লবণ । অথচ খিদে তেষ্টায় তাঁর প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল । প্রচণ্ড শীতের মধ্যে গায়ে বস্ত্র পর্যন্ত নেই , প্রচণ্ড ঠাণ্ডা শীতের মধ্যে আকাশের নিচে আশ্রয়হীনভাবে বস্ত্রহীনভাবে নদীতীরে শুয়ে থাকতে হবে । এছাড়াও বাঘ ভাল্লুকের আক্রমণে প্রাণনাশেরও আশঙ্কা আছে । 

( খ ) “ কোথা যাইতেছ ? যাইও না । ফিরিয়া যাও — পলায়ন কর । ” 

উত্তরঃ উক্তিটি কপালকুণ্ডলার । নৌকার সঙ্গীরা ফেলে চলে যাবার পর নবকুমারকে একাকী প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খিদে তেষ্টায় অধীর হয়ে নানা চিন্তা করতে করতে বালিয়াড়ির পাশে ঘুমিয়ে পড়ল । অনেক রাতে ঘুম ভাঙল । হঠাৎ বেশদূরে আলো দেখে নবকুমার তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটে গেল । সেখানে একজন কাপালিকের দর্শন পেল । কিছুক্ষণ পর কাপালিক নবকুমারকে নিজের পর্ণকুটিরে নিয়ে গেল । পরদিন ক্ষুধার্ত নবকুমার ফলের খোঁজে বেরলো । একটি গাছের ভীষণ সুস্বাদু ফল খেয়ে ঘন বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলল । একটু পরে সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হয়ে সে অনন্তশোভা দেখতে লাগল । 

সন্ধে উপস্থিত । হঠাৎ নবকুমার সেখানে এক অপূর্ব সুন্দরী রমণীকে দেখতে পেল । বহুক্ষণ পরে সেই তরুণী নবকুমারকে জিজ্ঞেস করল সে পথ হারিয়েছে কিনা । কোনো উত্তর না পেয়ে তরুণী আবার বলল “ আইস ” । কুটিরের কাছে এসেই সুন্দরী রমণী বনের মধ্যে চলে গেল । কুটিরে কাপালিকের সাথে নবকুমারের সাক্ষাৎ হল । কাপালিক নবকুমারকে সঙ্গে নিয়ে চলল । নবকুমার ভাবল এবার মনে হয় তার বাড়ি যাওয়ার কোনো উপায় হবে । কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ রমণী নবকুমারের পিঠে স্পর্শ করে মৃদুস্বরে বলল “ কোথা যাইতেছ ? যাইও না, ফিরিয়া যাও পলায়ন করল । ” 

( গ ) কখনও স্তূপতলে , কখনও স্তূপ শিখরে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন । 

উত্তরঃ বঙ্কিমচন্দ্র রচিত “ কপালকুণ্ডলা ” উপন্যাস থেকে বাক্যটি নেওয়া। নবকুমার গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার সময় এক নদীর মোহনায় সকলের উপকারের জন্য রান্নার উপযোগী কাঠ যোগাড় করতে গিয়েছিল । কিন্তু ফেরায় দেরী হয় এবং জোয়ারের বেগে নৌকা অনেকদূরে ভেসে যায় । নবকুমারের সঙ্গীরা এই পরিস্থিতিতে তার জন্য না ফিরে দেশের দিকে যাত্রা করল । 

নবকুমার ভালো করে নিরীক্ষণ করে বুঝল সে যেখানে আছে সেখানে গ্রাম নেই , আশ্রয় নেই , লোক নেই , খাদ্য নেই । নদীর জলে অসহ্য লবণ আছে । অথচ খিদে তেষ্টায় তাঁর জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠল । প্রচণ্ড শীত নিবারণের জন্য আশ্রয় নেই , গায়ের বস্ত্র পর্যন্ত নেই । 

মনের অস্থিরতার কারণে নবকুমার একজায়গায় বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারল না । তাঁর ত্যাগ করে উপরে উঠল । এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল । ক্রমশ অন্ধকার হয়ে এলো । আকাশে দেখা দিল নক্ষত্র । অন্ধকারে সর্বত্র জনহীন নীরব , সমুদ্রের গর্জন ছাড়া কোনো কিছুর শব্দ ছিল না কখনো হয়তো বন্য পশুর চিৎকার শুনতে পেল । তা সত্ত্বেও নবকুমার সেই অন্ধকারে হিমবর্ষণকারী আকাশের নিচে বালিস্তুপের চারিপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল । কখনো উপত্যকায় , আবার কখনো বালিস্তুপের উপরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। পথ চলতে চলতে প্রতি পদক্ষেপেই হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা , আবার একজায়গায় বসে থাকলেও সেই সম্ভাবনা । 

( ঘ ) অকস্মাৎ এইরূপ দুর্গ মধ্যে দৈবী মূর্তি দেখিয়া নিস্পন্দ শরীর হইয়া দাঁড়াইলেন । তাঁহার বাকশক্তি রহিত হইল । স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিলেন। 

উত্তরঃ নবকুমার সমুদ্রতীরে বালিয়াড়ি ও অরণ্য সমাচ্ছন্ন একটি নির্জন স্থানে নৌকারোহীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হল । কাঠবহন করে নদীতীরে এসে সে নৌকা বা তার আরোহী কাউকে দেখতে পেল না । প্রথমে ভাবল, জোয়ারের বেগ কমে গেলে নৌকা ফিরে আসতে পারে । কিন্তু নৌকা আর ফিরল না । রাত্রি হল । নবকুমার ক্ষুধা তৃষ্ণায় এবং ভয়ে কাতর হয়ে পড়ল । এমতাবস্থায় সে অনেকদূরে একটি আলো দেখতে পেল । 

আলোর কাছে গিয়ে দেখল শবের উপর বসে হোমাাগ্নি জ্বেলে এক কাপালিক ধ্যান করছে । নবকুমার অস্থি , নরকঙ্কাল , শব , কারণ বারি এবং অগ্নিবেষ্টিত কাপালিকের কাছে ভীতচি অনেকক্ষণ বসে থাকল । কাপালিকের পূজা শেষ হলে , নবকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল এবং অবশেষে তাকে এক পাতার কুটিরে শুতে স্থান দিল এবং ফলমূল খেতে দিল । নবকুমার ফল খেয়ে ক্লান্তিতে ও চিন্তায় ঘুমিয়ে পড়ল । 

পরেরদিন বিকালে নবকুমার কুটিরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বনান্তরালে সমুদ্রতীরে গিয়ে উপস্থিত হল । সমুদ্রতীরে সন্ধ্যা নামল । সে এক তরুণীর সাক্ষাৎ লাভ করল । তরুণীটি যেন বনমালা , আশ্চর্য সুন্দরী । নবকুমারকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সে কুটিরের পথ দেখিয়ে দিল।

ব্যাকরণ :

প্রশ্ন ১। সন্ধি – বিচ্ছেদ করো । 

( ক ) প্রতীক্ষা — প্রতি + ইক্ষা ( স্বরসন্ধি ) 

অত্যন্ত — অতি + অন্ত ( স্বরসন্ধি ) 

প্রত্যাগমন — প্রতি + আগমন ( স্বরসন্ধি ) 

নিরাশ্রয় — নিঃ + আশ্রয় ( স্বরসন্ধি ) 

দিগন্ত — দিগ্‌ + অন্ত ( ব্যঞ্জন সন্ধি ) 

পুনরুদ্দীপ্ত — পুনঃ + উদ্দীপ্ত ( বিসর্গ সন্ধি ) 

অত্যুচ্চ — অতি + উচ্চ ( স্বরসন্ধি ) 

শ্রেয়স্কর — শ্রেয় + কর ( বিসর্গ সন্ধি ) 

কিঞ্চিত — কিম + চিৎ ( ব্যঞ্জন সন্ধি ) 

সন্ন্যাস — সম + ন্যাস ( ব্যঞ্জন সন্ধি ) 

নিজে করো — 

পঞ্চাশ , মৃন্ময় , নিরীক্ষণ , পর্যন্ত , ইতস্তত , নীরব , সময়ান্তরে , সদুপায় । 

উত্তরঃ মৃন্ময় — মৃৎ + ময় ।

নিরীক্ষণ — নিঃ + ঈক্ষণ ।

পর্যন্ত — পরি + অন্ত ।

ইতস্তত — ইতঃ + তত ।

নীরব — নিঃ + রব ।

সময়ান্তরে — সময় + অন্তরে ।

সদুপায় — সৎ + উপায় । 

( খ ) ব্যাসবাক্যসহ সমাসের নাম লেখো । 

পর্ণকুটির , দেহরত্ন , পথভ্রান্তি , অনুচিত , কণ্ঠাগত , কার্পাসবস্ত্র, শিখরাসীন , তন্দ্রাভিভূত , কাষ্ঠভার । 

উত্তরঃ পর্ণকুটির — পর্ণের যে কুটির ― কর্মধারয় সমাস । 

দেহরত্ন — দেহ রূপ রত্ন ― রূপক কর্মধারয় ।

পথভ্রান্তি — পথের ভ্রান্তি ― ষষ্ঠী তৎপুরুষ । 

অনুচিত — নয় উচিত ― নঞ তৎপুরুষ । 

কণ্ঠাগত — কণ্ঠ পর্যন্ত আগত — অপাদান তৎপুরুষ । 

কার্পাসবস্ত্র — কার্পাস ও বস্ত্র ― দ্বন্দ্ব সমাস । 

শিখরাসীন — শিখরে আসীন — অধিকরণ তৎপুরুষ । 

তন্দ্রাভিভূত — তন্দ্রার দ্বারা অভিভূত ― করণ তৎপুরুষ । 

কাষ্ঠভার — কাষ্ঠের ভার ― ষষ্ঠী তৎপুরুষ । 

( গ ) বাক্যরচনা করো : 

আকাশকুসুম , আক্কেল সেলামী , আদাজল খেয়ে , আঁতে ঘা , কেঁচে গণ্ডুষ , কূপমণ্ডুক , চিনির বলদ , টনক নড়া , ধর্মের ষাঁড়, পায়াভারি । 

উত্তরঃ আকাশকুসুম — কমলবাবুর আকাশকুসুম কল্পনা করাই অভ্যাস। 

আক্কেল সেলামী — বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠায় ভদ্রমহিলাকে টিকিট কালেক্টরের ডবল ভাড়া শুনে আক্কেল সেলামী দিতে হলো । 

আদাজল খেয়ে ― পরীক্ষায় সফল হতে চাইলে আদাজল খেয়ে চেষ্টা করো ।

আঁতে ঘা — কাউকেই আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলা উচিত নয় । 

কেঁচে গণ্ডুষ — পুজোর ছুটিতে আড্ডা মেরে হরিলাল সব অঙ্ক ভুলে গেছি , এখন আবার আমায় কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে । 

কূপমণ্ডুক — সংস্কার অথবা কুসংস্কারের বশীভূত হলে এমনই কুপমণ্ডুক হয়ে পড়তে হবে যে , আমাদের স্বাধীন বিচারশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে । 

চিনির বলদ — গোপালবাবু সংসারের জন্য সারা জীবন খেটেই গেলেন যেন চিনির বলদ । 

টনক নড়া — আমার সতর্ক হবার কথাটা অপূর্ব কানেই নেয়নি , এখন আসন্ন সংকটে ওর টনক নড়েছে । 

ধর্মের ষাঁড় — কৌস্তভ বি.এ. পাশ করে ধর্মের ষাঁড় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

পায়াভারি — সরকারী উচ্চপদে চাকরি পেয়ে অমলের পায়াভারি হয়েছে ।

( ঘ ) সন্ধি ও সমাসের মধ্যে পাঁচটি পার্থক্য নিরূপণ করো । 

উত্তরঃ সন্ধি ও সমাসের মধ্যে পাঁচটি পার্থক্য : 

( ১ ) সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন । পরস্পর সন্নিহিত দুটি ধ্বনির মিলনের নাম সন্ধি । সন্ধিতে পূর্বপদের শেষ বর্ণের সঙ্গে পরপদের প্রথম বর্ণের মিলন ঘটে। 

( ২ ) সন্ধি তিন প্রকার — স্বরসন্ধি , ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি । অপরদিকে সমাস পাঁচ প্রকারের কর্মধারয় , তৎপুরুষ , দ্বন্দ্ব , বহুব্রীহি , দ্বিগু । 

( ৩ ) সন্ধির মিলন উচ্চারণগত , কিন্তু সমাসের মিলন অর্থগত ।

( ৪ ) সন্ধিতে পদ থেকে বিভক্তিলোপের ব্যাপার নেই , অপরদিকে সমাসে বিভক্তি চিহ্ন লুপ্ত হওয়া আবশ্যিক ।

( ৫ ) সন্ধি শব্দার্থে কোনও পরিবর্তন আনে না , কিন্তু শব্দার্থে সমাসের প্রভাব গুরুতর । এটি শব্দার্থের বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে । 

( ঙ ) অর্থানুসারে বাক্য রচনা করো । 

অস্ত্যর্থক , নস্ত্যর্থক এবং প্রশ্নাত্মক বাক্য 

( চ ) অস্ত্যর্থক বাক্যে পরিবর্তন করো । 

নস্ত্যর্থক — আমি কখনও মিথ্যা কথা বলি না । 

অস্ত্যর্থক — আমি সর্বদা সত্য কথা বলি । 

নস্ত্যর্থক — পৃথিবীতে কেহ অমর নয় । 

অস্ত্যর্থক — পৃথিবীতে সকলেই মরণশীল । 

নস্ত্যর্থক — এ কাজ করা সম্ভব নয় । 

অস্ত্যর্থক — এ কাজ করা অসম্ভব । 

নস্ত্যর্থক — কে না সন্তানকে ভালবাসে । 

অস্ত্যর্থক — সকলেই সন্তানকে ভালবাসে । 

নস্ত্যর্থক — কেনা জন্মভূমিকে ভালবাসে । 

অস্ত্যর্থক — সবাই জন্মভূমিকে ভালবাসে ।

( ছ ) নস্ত্যর্থক বাক্যে পরিবর্তন করো । 

অস্ত্যর্থক — কাপুরুষেরা মৃত্যুকে ভয় করে । 

নস্ত্যর্থক — কাপুরুষ ছাড়া কেহই মৃত্যুকে ভয় করে না । 

অস্ত্যর্থক — সে ছিল মূর্খ । 

নস্ত্যর্থক — সে পণ্ডিত ছিল না । 

অস্ত্যর্থক — পৃথিবীতে তুমি অতুলনীয় । 

অস্ত্যর্থক — পৃথিবীতে তোমার তুলনা নেই । 

( ঝ ) প্রশ্নাত্মক বাক্যে পরিবর্তন করো । 

অস্ত্যর্থক — টাকায় সবই পাওয়া যায় । 

প্রশ্নাত্মক — টাকায় কী না পাওয়া যায় । 

অস্ত্যর্থক — জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হতেও বড় । 

প্রশ্নাত্মক — জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হতেও বড় নয় কি ? 

নস্ত্যর্থক — পরের অনিষ্ট করা উচিত নয় । 

প্রশ্নাত্মক — পরের অনিষ্ট করা কি উচিত ?

Leave a Reply

error: Content is protected !!
Scroll to Top