বন্ধু-বান্ধৱীসকল আজকে আমরা আলোচনা করব যে কিভাবে বাংলাতে শিবনাথ শাস্ত্রীর বিষয়ে জীবনী – Sivanath Shastri Biography in Bengali লিখতে হয়। আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনাদের উপকৃত হবে। সুতরাং বেছি সময় নষ্ট না করে চলুন আরম্ভ করি।
শিবনাথ শাস্ত্রী জীবনী – Sivanath Shastri Biography in Bengali
শিবনাথ শাস্ত্রী
সাহিত্য ও সংস্কৃতি
জন্ম: ৩১শে জানুয়ারী ১৮৪৭ খ্রিঃ
মৃত্যু: ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯১৯ খ্রিঃ
প্রথম জীবনের এক বিশেষ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মনের মানি কাটিয়ে ওঠার জন্য স্বনামধন্য শিবনাথ শাস্ত্রী সংকল্প করেছিলেন, ‘কর্তব্য বুঝিব যাহা, নির্ভয়ে করিব তাহা ।”
সারা জীবনে এই সংকল্প তিনি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করেছিলেন। দেশ ও সমাজের কাজে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। স্বার্থপরতা কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
শিবনাথের কর্মময় জীবন গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থির রেখে। তার উদ্দেশ্য ছিল মানবসেবা। তার জীবন, কর্ম ও চিন্তা ব্যয়িত হয়েছে ব্রাহ্মসমাজকে কেন্দ্র করে। কিন্তু অন্তরে তিনি ছিলেন একজন উচ্চভাবের সাধক। নিজের জীবনেই তিনি বহুবার ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্ম হয়েছিল ১৮৪৭ খ্রিঃ ৩১শে জানুয়ারী। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার চাঙ্গড়িপোতা গ্রামে ছিল তাঁর মামার বাড়ি। সেখানেই মাতামহীর কোলে তাঁর জন্ম হয়।
মাতামহী ছিলেন শিবনাথের প্রাণ। তাঁর জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিলেন এই ব্রাহ্মণী। শিবনাথ তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন, “আমার মাতামহীর ন্যায় ব্রাহ্মণকন্যা বিরল। বলিতে কি, তাহাকে আমি যখন স্মরণ করি, আমার হৃদয় পবিত্র ও উন্নত হয় এবং একথা আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমাতে যে কিছু ভালো আছে, তাহার অনেক অংশ তাঁহাকে দেখিয়া পাইয়াছি।”
শিবনাথের বাবার নাম হরানন্দ ভট্টাচার্য এবং মা গোলকমণি। গোঁড়া ব্রাহ্মাণ হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদাশয়, পরোপকারী ও আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি।
সেই সঙ্গে ছিল চণ্ডালে রাগ। একবার কোন কারণে রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
হরানন্দ কিরকম রাগী পুরুষ ছিলেন একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বললেই বুঝতে পারবে।
গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান শিবনাথ ছাত্র জীবনে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সেই সংবাদ পেয়ে কুপিত হয়ে হরানন্দ ছেলেকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেন।
কিন্তু এতেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। মজিলপুর সরকারী স্কুলের পঁচিশ টাকা বেতনের পণ্ডিত বাইশ টাকা খরচ করে গুণ্ডা নিয়োগ করেছিলেন, পুত্র যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে।
শিবনাথ ছিলেন মাতৃভক্ত ছেলে। মাকে না দেখে থাকতে পারতেন না তিনি। বাবার পোষা গুণ্ডার ভয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে সাবধানে তিনি মজিলপুরে যেতেন মাকে দেখার জন্য।
শিবনাথের বড় মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন সেযুগের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি সোমপ্রকাশ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
শিবনাথের জন্মের একসপ্তাহ পরে মাথা ও কপাল দেখে দ্বারকানাথ বলেছিলেন, “আমার এই ভাগিনা বড়লোক হবে।”
তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে শিবনাথের নাম।
সাহিত্য প্রতিভা ছিল তাঁর সহজাত। জ্বলন্ত দেশপ্রেম সুগভীর মানবপ্রেম তাঁকে ধর্মপ্রচার, সমাজ সংসার লোকসেবা ও স্বাধীনতা লাভের বিপুল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত করেছিল।
সে যুগে মেয়েদের শিক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না। হরানন্দ তাঁর স্ত্রীকে বাড়িতে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বালক শিবনাথের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল তার মায়ের কাছে।
মা গোলকমণি ছিলেন ধর্মপরায়ণা, নিষ্ঠাবতী ও কর্তব্যপরায়ণা মহিলা। পুত্রের বাল্যশিক্ষার কোনও ত্রুটি তিনি রাখেন নি।
পাঁচ বছর বয়সে মজিলপুর গ্রামের পাঠশালায় শিবনাথের প্রথম বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়। সেই সময় বাংলার গভর্নর লর্ড হার্ডিঞ্জের উদ্যোগে দেশে কতকগুলি আদর্শ বাংলা স্কুল স্থাপিত হয়েছিল।
মজিলপুর গ্রামেও সেরকম একটি আদর্শ স্কুল ছিল। কিছুদিন পাঠশালায় পড়ার পর তাঁর মা শিবনাথকে সেই আদর্শস্থলে ভর্তি করেছিলেন।
আদর্শ বাংলা বিদ্যালয়ে পড়াশুনা চলছে। তাঁর তখন মাত্র ন’ বছর বয়স। সেই সময়েই শিক্ষকতা শুরু করতে হয় তাঁকে মাষ্টারমশাই শিবনাথ। ছাত্রী তাঁর বাবার সম্পর্কিত এক খুড়ি বিধবা। শিবনাথের চেয়ে বয়সে পাঁচগুণ বড়। এই ছাত্রীকে ক্ষুদে মাষ্টারমশাই বর্ণপরিচয় পড়াতেন।
ছেলেবেলাতেই এভাবে শিক্ষকতায় হাতেখড়ি হয়েছিল ভবিষ্যতের শিক্ষাগুরু শিবনাথের।
গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় শিবনাথ ভোরে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুল তুলতে যেতেন। আমের মরশুমে আম কুড়োতেন । ডানপিটেমি বিশেষ একটা করতেন না।
স্বভাবজাত ভাবুক মন ছিল তাঁর। মাঝেমধ্যেই মাঠের কোলাহল এড়িয়ে একা একা উদাস ভাবে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। প্রকৃতিকে দেখতেন দুচোখ ভরে।
ছেলেবেলায় তাঁর এক নেশা ছিল, পশুপাখি পোষা। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে টুনটুনি, দোয়েল, বুলবুলির বাসা খুঁজতেন। বাসা থেকে কটি পাখির ছানা নামিয়ে নিয়ে এসে খাঁচায় রেখে পুষতেন।
টিয়াপাখি ধরতেন ফাঁদ পেতে। খাঁচায় ভরে তাকে বোল শেখাবার চেষ্টা করতেন। তোমরা শুনলে অবাক হবে, বালক শিবনাথ কেবল পাখিই পুষতেন না, তাঁর পোষা প্রাণীদের তালিকায় পিঁপড়ে, ফড়িংও বাদ ছিল না।
কি করে যে ওইটুকুনি বয়সে ওরকম বিচিত্র সব প্রাণী তিনি পোষ মানাতেন, ভাবলেও অবাক হতে হয়।
পরিণত বয়সে সুগভীর মানবপ্রেম যাঁকে লোকসেবার ব্রতে নিয়োজিত করেছিল, ছেলেবেলায় ইতর প্রাণীদের লালনপালনের মধ্য দিয়ে তাঁর সেই ভাবটিই প্রকাশ পেয়েছিল।
নয় বছর বয়সে শিবনাথের উপনয়ন হয়। উপনয়নের পরেই তাঁর বাবা হরানন্দ ছেলেকে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসেন। তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় সংস্কৃত কলেজে।
সেই সময় সংস্কৃত কলেজে বিশেষ করে ইংরাজী শিখানো হত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন ঐ কলেজের অধ্যক্ষ। শিবনাথের বড় মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন সেখানকার সাহিত্যের অধ্যাপক।
কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে শিবনাথকে পড়াশুনা করতে হয়েছিল। এই সময় তাঁকে নানা দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল।
মামার বাড়িতে যাদের সঙ্গে তিনি থাকতেন তাদের মধ্যে অনেকেরই নানান কুঅভ্যাস ছিল। তাদের নৈতিক চরিত্রও ভাল ছিল না। কিন্তু এসব কিছুই বালক শিবনাথকে প্রভাবিত করতে পারেনি। স্কুলের বিভিন্ন পরীক্ষায় তিনি বরাবর কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
মামার বাড়িতে একটি ঘরে এক চিত্রকর থাকতেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর আঁকা সুন্দর সুন্দর অনেক ছবি ছিল। স্কুল থেকে ফিরে শিবনাথ চিত্রকরের ঘরে চলে যেতেন। বসে বসে নিমগ্ন হয়ে ছবি দেখতেন।
আত্মচরিতে তিনি লিখেছেন, “আমার ছবি দেখার নেশা সেই অবধি অদ্য পর্যন্ত যায় নাই। আমাকে উৎকৃষ্ট ছবির মধ্যে রাখিয়া দিলে বোধহয় আহার নিদ্রা ভুলিয়া ঘন্টার পর ঘন্টা থাকিতে পারি।”
বড়মামা কিছুদিনের মধ্যে সেই বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে উঠে গেলে শিবনাথ তাঁর বাবার সঙ্গে বউবাজারের জেলিয়াপাড়ায় চলে আসেন ।
এই জেলিয়াপাড়ায় থাকার সময় শিবনাথ তাঁর
এক সহপাঠীকে উদ্দেশ্য করে প্রথম কবিতা রচনা করেন। কবিতাটির প্রথম চার লাইন ছিল এরকম—
ইজার চাপকান গায় ইস্কুলে আসে যায়
নাম তার গঙ্গাধর হাতি
বড় তার অহঙ্কার ধরা দেখে সবাকার
চলে যেন নবাবের নাতি।
এই কবিতা সম্পর্কে শিবনাথ পরে বলেছেন, “রাধাগোবিন্দ মৈত্র তখন আমাদের ইংরাজির মাষ্টার ছিলেন। তিনি কবিতাটি আমার হাত হইতে লইয়া মনোযোগ পূর্বক পাঠ করিলেন এবং আমার মস্তকে হাত দিয়া বলিলেন, তোমার কবিতা বেশ হয়েছে। কিন্তু মানুষকে গালাগালি দিয়ে কবিতা লেখা ভালো নয়।” ইহার পর আমার কবিতা লেখার উৎসাহ বাড়িয়া গেল।
পরবর্তীকালের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শিবনাথ শাস্ত্রীর সাহিত্য জীবনের সুত্রপাত এভাবেই হয়েছিল ছেলেবেলাতেই।
সেইকালের কুলপ্রথা অনুসারে অত্যন্ত শিশু বয়সেই শিবনাথের প্রথম স্ত্রী প্রসন্নময়ীর সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধ স্থির হয়েছিল।
যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন তাঁর বয়স ছিল দুই বছর, এবং প্রসন্নময়ীর বয়স একমাস মাত্র।
জেলিয়াপাড়াতে থাকার সময় মাত্র ১২,১৩ বছর বয়সে শিবনাথের সঙ্গে প্রসন্নময়ীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। শিবনাথ লিখেছেন, “এই বিবাহকালীন সকল বিষয় আমার স্মরণ নাই। এইমাত্র স্মরণ আছে যে, আমি কানে মাকড়ি, গলায় হার, হাতে বাজু ও বালা পরিয়া বিবাহ করিতে গিয়াছিলাম।”
কিশোর বয়সে এই বিবাহের ঘটনার মধ্যে দিয়ে শিবনাথ তাঁর কর্মবহুল জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন।
সমাজ সংস্কারক শিবনাথের প্রধান পরিচয় কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রূপে। তাঁর বিখ্যাত তথ্যমূলক গ্রন্থ আত্মচরিত এবং রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ।
প্রবন্ধকার রূপে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ—হিমাদ্রিকুসুম, নির্বাসিতের বিলাপ, নয়নতারা, বিধবার ছেলে, ধর্মজীবন, রামমোহন রায়, History of Brahmo Samaj, Men I have seen প্রভৃতি।
শিবনাথ রচিত মেজবৌ উপন্যাসের ইংরাজি অনুবাদ ইংলণ্ডের Indian National Journal-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮৯৫ খ্রিঃ প্রকাশিত মুকুল পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। ১৯১৯ খ্রিঃ ৩০শে সেপ্টেম্বর শিবনাথ শাস্ত্রী লোকান্তরিত হন।
৷ অমৃতবাণী ॥
* “চরিত্রের সম্পদ যাঁহার আছে তাহার
অন্য সম্পদ আপনি আসে”
* “যেখানে সত্য সেখানেই ঈশ্বর”
অনুগ্রহ করে মন করবেনঃ শিবনাথ শাস্ত্রীর বিষয়ে জীবনী – Sivanath Shastri Biography in Bengali আমাদের এই লেখা যদি আপনার জন্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে তাহলে আপনি আমাদেরকে নিছে Comment Box এ Feedback দেওয়ার জন্য অনুরোধ রইল। আপনাদের এই ছোট্ট Feedback এ আমাদেরকে কাজের জন্য উৎসাহ জাগায়।
Hi! I’m Ankit Roy, a full time blogger, digital marketer and Founder of Roy Library. I shall provide you all kinds of study materials, including Notes, Suggestions, Biographies and everything you need.